‘দ্বিতীয় বাড়ি’তে নিরাপত্তা নেই

লখনউতে সম্প্রতি সাত বছরের এক শিশুকে খুনের চেষ্টা করা হয়েছে। খুন ভারতে রোজ হয়। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তবু এ ক্ষেত্রে আমরা একেবারে চমকে গিয়েছি। কারণ অপরাধ সংঘটিত হয়েছে একটি স্কুলের শৌচাগারে।

Advertisement

সোনালী দত্ত

শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share:

লখনউতে সম্প্রতি সাত বছরের এক শিশুকে খুনের চেষ্টা করা হয়েছে। খুন ভারতে রোজ হয়। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তবু এ ক্ষেত্রে আমরা একেবারে চমকে গিয়েছি। কারণ অপরাধ সংঘটিত হয়েছে একটি স্কুলের শৌচাগারে। অভিযুক্ত ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রী। অভিযোগ, প্রথম শ্রেণির ছাত্রটিকে সে কুপিয়ে খুন করতে চেয়েছিল, শুধুমাত্র তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি পাওয়ার উদ্দেশ্যে।

Advertisement

মনোবিদ বা সমাজতত্ত্ববিদ কী বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেবেন, জানি না। আমরা কেবল এই ভেবে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই, যে ‘সভ্যতা’ আমাদের এমন নরকে এনে দাঁড় করাল যেখানে এমন অসম্ভব রকমের তুচ্ছ কারণে এক শিশু আর এক শিশুকে খুন করতে উদ্যত হচ্ছে? তাও আবার স্কুলে, যাকে ছাত্রছাত্রীদের ‘দ্বিতীয় বাড়ি’ বলা হয়? না, ব্যতিক্রমী ঘটনা তো বলা যাচ্ছে না। গত বছর গুড়গাঁও-এর একটি স্কুলে একাদশ শ্রেণির ছাত্র দ্বিতীয় শ্রেণির এক ছাত্রকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়, সে-ও নাকি পরীক্ষা ও অভিভাবক-শিক্ষক মিটিং পিছিয়ে দিতে এই কাজ করেছিল।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, এ দেশের স্কুলগুলিতে শিক্ষার্থীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা প্রয়োজনানুগ নয়। আমাদের রাজ্যও গত বছর একটি স্কুলের চার বছরের একটি ফুলের মতো শিশুকে রক্তাক্ত হতে দেখেছে, তার কারণ যা-ই হোক, আর তখন স্কুল কর্তাদের নজরে এসেছে, তাঁদের নামী স্কুলের দামি পরিসরে কোনও সিসিটিভির নজরদারি নেই। বস্তুত, সমস্যার শিকড় আরও গভীরে। স্কুল চত্বরে শিশুর উপর আক্রমণ কোন জায়গা থেকে আসতে পারে, তার কারণ কী হতে পারে, তা আগে থেকে আন্দাজ করাই অসাধ্য হয়ে পড়ছে।

Advertisement

লখনউয়ের স্কুলটির খবর যে দিন সংবাদ শিরোনামে এসেছে, সে দিই আর একটি খবরও টিমটিম জ্বলছিল। চেন্নাইয়ের পেরাম্বুরে দশম শ্রেণির এক ছাত্র নিহত হয়েছে। অভিযোগ, দেরি করে স্কুলে আসায় শারীরশিক্ষার শিক্ষক তাকে ‘হাঁস হাঁটা’য় বাধ্য করেন। এমন ‘হাঁটা’ সে হাঁটে, যে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং মারা যায়। কিছুকাল আগে একটি গ্লোবাল সার্ভে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সারা বিশ্বের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে যে পরীক্ষা চালানো হয়েছিল, তাতে আটচল্লিশ শতাংশ ভারতীয় ছেলেমেয়ে স্কুলে নিজেদের নিরাপত্তাহীন মনে করে বলে রিপোর্টে জানানো হয়েছে। এর কারণ শারীরিক শাস্তি, যৌন নির্যাতন, বিকৃত মানসিকতা ইত্যাদি নানা কিছু হতে পারে।

এই কিছু দিন আগেই তো মধ্যপ্রদেশে জলের কলে হাত দেবার ‘অপরাধ’-এ ন’বছরের দলিত ছাত্রকে শিক্ষকরাই মেরেধরে কুয়োয় ফেলে দিলেন। দলিত ছাত্রী স্কুলের ক্লাসঘরে নিয়মিত ধর্ষিত হয়েছে, এমন খবর তো এখন আর অনিয়মিত নয়। আর শুধু দলিত কেন, দেশের রাজধানীতেই স্কুলের অশিক্ষক কর্মচারী পাঁচ বছরের শিশুকে ধর্ষণ করছে! চার বছরের ছাত্রীকে শৌচাগারে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করতে চেষ্টা করছে চার বছরের সহপাঠী। তার হাতে সরু করে ছোলা পেন্সিল।

প্রায় সর্বক্ষেত্রেই স্কুলগুলি অপরাধ লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করে, অভিভাবক এবং পুলিশের কাছে তথ্য গোপন করে বলে অভিযোগ ওঠে। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর মিটিং মিছিল অবরোধ হয়। সচেতনতাও যে বাড়ে না, তা নয়। শিশু শ্রেণিতে আয়ার সংখ্যা বাড়ে, পুরুষ শিক্ষকের খেলার ক্লাসে মহিলার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক হয়। শৌচাগারে নজরদারি বাড়ে। এই প্রচেষ্টাকে আমরা ছোট করে দেখি না। তবু স্কুল কর্তৃপক্ষ, পুলিশ, সরকার, সকলের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলতে গিয়েও কোথাও কোথাও স্তব্ধ হয়ে যাই। দ্বিতীয় বাড়িতে বড় ভরসা করে অভিভাবক সন্তানকে পাঠান। তিনি কি ভাবতে পারেন, তার সহপাঠী আর এক শিশু তাঁর সন্তানকে এমন আঘাত হানতে পারে? শিক্ষক ছাত্রীকে ধর্ষণ করতে পারেন? আমরাই কি ভাবতে পারি, শুধুমাত্র তাড়াতাড়ি ছুটি পাওয়ার জন্যে এক বালিকা আর এক অবোধ শিশুকে হত্যা করতে উদ্যত হবে?

অনেক স্কুলে নাকি শিক্ষক অশিক্ষক সমস্ত কর্মচারীর ‘সাইকোমেট্রিক ইভ্যালুয়েশন’ হচ্ছে। হয়তো পাঠ্যসূচিতেও নীতিশিক্ষা, যৌনতার শিক্ষা ইত্যাদির উপর জোর দেওয়া হবে। হয়তো কাউন্সেলিং-এর জন্য মনোবিদ নিযুক্ত হবেন, সিসিটিভিতে চোখ রেখে গোয়েন্দা বসে থাকবেন। কিন্তু রোদের মাঠে উদ্দাম ছুটোছুটি? তার কী হবে? সিঁড়ির ছায়ায় বসে ফিসফিস গল্পের কী হবে? আর সেই পেন্সিলটা? শার্পনার দিয়ে ছোলা পেন্সিল হাতে ধর্ষণে উদ্যত এক চার বছরের অপরাধী কোন টিভির ক্যামেরায় ধরা পড়বে? কোন ইরেজারে সেই ভয়ংকর আকালকে মুছে ফেলা যাবে, যখন একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবে বলে এক শিশু আর এক শিশুকে কুপিয়ে খুন করতে চায়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন