—ফাইল চিত্র।
ক্ষমতা থাকা আর ক্ষমতা দেখানো এক বিষয় নয়। ক্ষমতাবান হওয়া দোষের নয়, কিন্তু ক্ষমতার দেখনদারিতে বড় বিপদ রয়েছে। শঙ্খ ঘোষের কণ্ঠ থেকে এল কথাগুলো, এল আপ্তবাক্যের মতো হয়ে।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলেছেন কবি। প্রেসিডেন্সির বর্তমান গতিপ্রকৃতি বা চালচলনের বিষয়ে নিশ্চয়ই প্রাসঙ্গিক কথাগুলো। কিন্তু শুধুমাত্র প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এ কথনের প্রাসঙ্গিকতার প্রেক্ষাপটটা আজ অনেকটা বড়।
এক সামান্য সিভিক ভলান্টিয়ার থেকে শুরু করে শীর্ষ রাজনীতিক— ক্ষমতার আস্ফালনে উদ্গ্রীব এ সময়ে সকলেই। সমাজে, রাজনীতিতে, প্রশাসনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে— সর্বত্র ক্ষমতা দেখানোর আশ্চর্য প্রতিযোগিতা, ভিড় আস্ফালনে উদগ্র অজস্র মুখের। বিপদের বীজটা ওই আস্ফালনের গর্ভেই।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পড়ুয়াদের এবং প্রাক্তনীদের সঙ্ঘাত তথা মতান্তর ক্রমশ বাড়ছে। মতান্তর সম্ভবত স্থায়ী মনান্তরেও পর্যবসিত হচ্ছে কোনও কোনও পরিসরে। মতান্তর কোনও অস্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়, তা মনান্তরে গড়িয়ে যাওয়া কাম্য না হলেও বেনজির কিছু নয়। কিন্তু অবিরত এই মতান্তরের পথে হেঁটে কর্তৃপক্ষ কি প্রেসিডেন্সিকে বিরল কোনও উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পেরেছেন? যে গৌরব প্রেসিডেন্সি অর্জন করেছে প্রায় দুই শতাব্দী ধরে, সেই গৌরব কি বর্তমান কর্তৃপক্ষের হাত ধরে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে? নাকি মহিমায় ভাটার টান আজ?
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ আসন শূন্য থাকে। মেধার সর্বোৎকৃষ্ট স্রোত আজও সর্বাগ্রে প্রেসিডেন্সি-মুখী, এমনটা আর বলা যায় না। মেধাবী পড়ুয়ার স্বপ্নে সম্ভবত প্রেসিডেন্সি আজ আর দেখা দেয় না। মোহভঙ্গের বাতাস যেন পাক খায় আজ দুই শতাব্দী পুরনো প্রতিষ্ঠানটার চার পাশে। প্রবল ক্ষমতাশালী তথা প্রতাপশালী কর্তৃপক্ষকেই তো এই মোহভঙ্গের দায়টা নিতে হবে। অপছন্দের সব মতকে বর্জন করে যদি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং তারও উপরের কোনও কর্তৃপক্ষ বার বার নিজেদের মতকেই প্রতিষ্ঠা দেওয়ার চেষ্টা করেন, স্রেফ ‘ক্ষমতা’র সুবাদে অন্য সব দৃষ্টিভঙ্গিকে যদি হেলায় সরিয়ে রাখেন একপাশে, তা হলে দায় তো দিনের শেষে ওই সব কর্তৃপক্ষেরই। সাফল্য এলে, সে কৃতিত্বও যেমন তাঁদের, এড়িয়ে যেতে পারবেন না তেমনই ব্যর্থতার দায়ও। দায়টা স্বীকার করে নেওয়ার ‘ক্ষমতা’ কি রয়েছে ‘ক্ষমতাশালী’ কর্তৃপক্ষের?
আরও পড়ুন
প্রেসিডেন্সির টান কমছে, উদ্বিগ্ন শঙ্খবাবু
প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরগুলিতে যে ভাবে দৃশ্যমান ক্ষমতার আস্ফালনের সংস্কৃতি, অধস্তন ধাপগুলিতে তা যে অবধারিত ভাবে এবং অপ্রতিরোধ্য গতিতে চারিয়ে যাওয়ার কথা, সে বলাই বাহুল্য। আস্ফালনের সংস্কৃতি যে চারিয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই, তার ভয়ঙ্কর প্রমাণটা হাতেনাতে মিলল মধ্যমগ্রামে। ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা করলেন এক সিভিক ভলান্টিয়ার। জীবনদায়ী ব্যবস্থাপনার যে নির্দেশিকা রাজ্য প্রশাসন বেঁধে দিয়েছে বাইক আরোহীদের জন্য, সে নির্দেশিকার ঈষৎ লঙ্ঘন দেখেই সিভিক ভলান্টিয়ার ঝাঁপিয়ে পড়লেন, ক্ষমতার উল্লাসে বাইক আরোহীর জীবনটাই কেড়ে নিলেন। ক্ষমতার দেখনদারির সংস্কৃতি চারিয়ে দিয়েছেন যে প্রশাসকরা, মধ্যমগ্রামের অপঘাতটির দায় স্বীকার করার ‘ক্ষমতা’ কি তাঁদের রয়েছে?
কবি-সাহিত্যিকদের ত্রিকালদর্শী বলা হয়। তাঁদের গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে ধরা দেয় সেই সুবৃহৎ পরিসর, সেই সব সম্ভাবনা, সেই সব আশঙ্কা, যার নিহিতি বৃহত্তর কালের গর্ভে, যা সাধারণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। কবি শঙ্খ ঘোষের ভাষ্যে সেই ত্রিকালদর্শনের ইঙ্গিতই রয়েছে। সামাজিক কাঠামোয়, রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে, প্রশাসনের গতিপ্রকৃতিতে একটা অসামঞ্জস্য অস্তিত্বশীল, কবির সতর্কবার্তায় সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট ভাবেই ধরা দিয়েছে।
এই অসামঞ্জস্যকে কি জয় করতে পারব আমরা? এক ত্রিকালদর্শীর কণ্ঠনিঃসৃত সতর্কবার্তা থেকে আমরা কি শিক্ষা নিতে পারব? যদি না পারি, ক্ষমতার দেখনদারির বিপদ সম্পর্কে এখনও যদি সচেতন না হই, বর্তমানের তুলনায় ভবিষ্যৎ অনেক রূঢ় হয়ে দেখা দেবে আমাদের সামনে।
আসলে চৈতন্যের প্রবাহেই ঈষৎ গলদ রয়ে গিয়েছে। ক্ষমতার অধিকারী হওয়া নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু সেই সৌভাগ্যকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা দেখছি, তা নির্ধারণ করে দেয় ক্ষমতার প্রয়োগের ধাঁচটা। ক্ষমতা পেয়ে যিনি নিজেকে ‘সক্ষম’ ভাবেন, তিনি অনেকের অক্ষমতা দূর করতে পারেন। আর ক্ষমতা পেয়ে যিনি নিজেকে ‘ক্ষমতাশালী’ ভাবেন, তিনি নিজেকে মানবিক ভাবে অক্ষম করে তোলেন, আরও অনেকের বিবিধ অক্ষমতার কারণও হয়ে ওঠেন। দৃষ্টিভঙ্গির এই ফারাকটা উপলব্ধি করলেই আমরা এগতে পারব সঙ্কটের নিরসনের পথে।