ভারত, শ্রীলঙ্কা, মলদ্বীপ এবং চিনা ড্রাগনের উষ্ণ শ্বাস

চাই শক্তিশালী মিত্রজোট

গত সেপ্টেম্বরে অপ্রত্যাশিত ভাবে জয়ী হয়ে মলদ্বীপের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন ইব্রাহিম মহম্মদ সোলি। এই সপ্তাহে নয়াদিল্লি সফরে এসে ভারতকেই ‘নিকটতম বন্ধু’ বলেছেন তিনি। প্রেসিডেন্ট সোলির নয়াদিল্লি সফর এবং এই ঘোষণা, দুই-ই তাঁর পূর্বসূরির একেবারে বিপরীত।

Advertisement

ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

প্রসন্ন: মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মহম্মদ সোলি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর যৌথ প্রেস কনফারেন্সের পর। দিল্লি, ১৭ ডিসেম্বর। পিটিআই

ভারতের সঙ্গে দুই প্রতিবেশী মলদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার সম্পর্ক ভাল-মন্দ মিশিয়েই চলে। আঞ্চলিক সমীকরণের অনিশ্চয়তাটা বোঝা যায় এখান থেকেই। প্রধানমন্ত্রী মোদী দায়িত্ব নেওয়ার পরে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক পোক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আশা করা গিয়েছিল, তাঁর তত্ত্বাবধানে সঙ্ঘবদ্ধ হবে দক্ষিণ এশিয়া— স্মরণাতীত কালে যা ঘটেনি। কিন্তু কোথায় কী। ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপপুঞ্জ মলদ্বীপের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক পুনরুদ্ধারে অনিশ্চয়তাই বলে দেয়, দক্ষিণ এশিয়ার ছবিটি কী প্রকার।

Advertisement

গত সেপ্টেম্বরে অপ্রত্যাশিত ভাবে জয়ী হয়ে মলদ্বীপের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন ইব্রাহিম মহম্মদ সোলি। এই সপ্তাহে নয়াদিল্লি সফরে এসে ভারতকেই ‘নিকটতম বন্ধু’ বলেছেন তিনি। প্রেসিডেন্ট সোলির নয়াদিল্লি সফর এবং এই ঘোষণা, দুই-ই তাঁর পূর্বসূরির একেবারে বিপরীত। আবদুল্লা ইয়ামিনের সব নীতিই ছিল বেজিংমুখী এবং ভারতবিরোধী। স্বৈরাচারী শাসনকালের শুরুতেই দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মহম্মদ নাশিদকে জেলে ভরেছিলেন ইয়ামিন। বাস্তব এবং কাল্পনিক কিছু শত্রু খাড়া করে নির্মম ভাবে সমস্ত স্বর চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। রেহাই পাননি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিও। এবং ভারতের সঙ্গে প্রায় সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন ইয়ামিন। এর ফলে ২০১৫-এ মলদ্বীপ সফর বাতিল করতে হয়েছিল মোদীকে। তাতেও বিচলিত না হয়ে চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে থাকেন ইয়ামিন। বৃহৎ প্রকল্পে টাকা ঢালতে থাকে চিনও। যেমন রাজধানী মালের সঙ্গে বিমানবন্দরের সংযোগকারী দু’কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রসেতু। মনে করা হয়, মলদ্বীপের ১১৯২টি দ্বীপেই বন্দর নির্মাণ ও সেনা মোতায়েনের অনুমতি ছিল চিনের। মালে সফরে এসেছিল চিনা নৌবাহিনী। নয়াদিল্লির সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সেনা মহড়া বাতিল করার পরেই স্পষ্ট হয়ে যায়, চিনা শিবিরে ঢুকে পড়েছে মালে।

অবশেষে ইয়ামিনের প্রস্থান এবং সোলির আগমনে চিনের চেনা ছকটি ধরা পড়েছে। যাবতীয় বিনিয়োগ আসলে মলদ্বীপকে ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে ফেলে বেজিংয়ের বজ্রমুষ্টি পোক্ত করার উদ্যোগ। মলদ্বীপের ঘাড়ে এখন আনুমানিক ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার চিনা ঋণের বোঝা। টাকার অঙ্কটা তাদের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি-র এক চতুর্থাংশেরও বেশি। ফাঁদ থেকে মুক্তির জন্য ১৪০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মোদী। আশা করা যায়, এই অর্থসাহায্য মলদ্বীপকে ফের দিল্লির দিকে নিয়ে আসবে।

Advertisement

আর এক প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কার আকস্মিক পটপরিবর্তনও দিল্লিকে খুশি করেছে। গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহেকে অসাংবিধানিক উপায়ে সরিয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষ। চিনপন্থী রাজনৈতিক ‘দখলদার’ হিসেবেই তাঁর পরিচিতি। অতি সম্প্রতি রাজাপক্ষকে গদি ছাড়তে হয়েছে।

বিক্রমসিংহের পুনর্নিয়োগকে সরাসরি স্বাগত জানিয়েছে ভারত। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রের বিবৃতি: ‘‘আমরা নিশ্চিত যে ভারত-শ্রীলঙ্কা সম্পর্ক উন্নতির পথে চলবে।’’ বস্তুত বেজিংকে প্রচুর সুযোগসুবিধে দিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজের দেশকে ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলেছিলেন রাজাপক্ষ। ফলস্বরূপ হাম্বানতোটা বন্দর চিনকে লিজ় দিতে বাধ্য হয়েছিল কলম্বো। বিক্রমসিংহে নিজে ভারতপন্থী হলেও শ্রীলঙ্কার রাজনীতিবিদদের একটা বৃহৎ ও শক্তিশালী অংশ তা নন। সেই তালিকায় দেশের প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপালা সিরিসেনাও আছেন, যিনি বিক্রমসিংহেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন।

মলদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার ধাক্কায় ভারতের উপশম হয়েছে ঠিকই, তবে তা সাময়িক। দুই দেশেরই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ভারতের পক্ষে গিয়েছে। অতএব, অভিভূত হওয়ার মতো কোনও ভূ-রাজনৈতিক বাঁকবদল ঘটেছে, বলা যাবে না। এই অঞ্চলে শক্তি হিসেবে চিন অত্যন্ত আকর্ষক— এ হল অপ্রিয় সত্য। বেশ কিছু জায়গা তার প্রভাবাধীন। তার ফলেই নয়াদিল্লির সঙ্গে ক্ষমতার ভারসাম্যের এ দিক ও দিক হয়। পাশাপাশি, দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে ভারতের আধিপত্য সংক্রান্ত ভীতিও তৈরি হয়ে ওঠে অনিবার্য ভাবে। তবে কি না, চিনা ড্রাগনের আলিঙ্গনের বিপরীতে ভারতের নরম ক্ষমতা বিস্তারের ঝোঁক হয়তো আঞ্চলিক নেতাদের খানিকটা ভাবাবে। বেজিংকে সর্বস্ব সমর্পণ করার আগে হয়তো একটু থমকাবেন তাঁরা। সব মিলিয়ে ভারত মহাদেশকে নিজেদের ক্রীড়াঙ্গন বানাতে চিনা প্রতিনিধিদের তৎপরতার কারণেই দিন দিন জটিলতর হয়ে উঠছে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির রাজনীতি। চিনের ‘ব্লু ওয়াটার নেভি’, আন্তর্জাতিক ভাবে কাজ করতে যার সক্ষমতা সর্বজ্ঞাত, তার দ্রুত উন্নয়নই প্রমাণ করে বেজিংয়ের দমনমূলক শাসনের প্রবণতা। উদাহরণ হিসেবে চিন সাগরের দিকে তাকানো যেতে পারে। আক্রমণাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বী চিন এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাব পরীক্ষা করে চলেছে, এবং তার জেরে নতুন নতুন অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই মলদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে অকস্মাৎ গতিপথ পরিবর্তন ও ভারতবিরোধী অগ্রগমন দেখা গিয়েছিল। এগুলোকে ব্যতিক্রমী ঘটনা না ভেবে স্বাভাবিক ঘটনাই ভাবা যেতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, তুলনায় ক্ষুদ্র এবং নিরাপত্তাহীন দেশগুলির অভ্যন্তরীণ অস্থির রাজনীতির আবর্তে যাতে ভারতের স্বার্থ বিপন্ন না হয়, তা নিশ্চিত করতে একটি বৃহত্তর ও সামগ্রিক ভূরাজনৈতিক কৌশল দিল্লিকে ভাবতে হবে।

একটা সম্ভাবনা এখানে বিবেচনা করতে হবে— জাপানের সঙ্গে ভারতের মিত্রতা। এই মিত্রতার কারণে কিন্তু ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের সেনাবাহিনী এবং অর্থনীতি, দু’টি স্বার্থই সুরক্ষিত থাকার কথা। জাপানের ইতিহাস যা-ই বলুক না কেন, অন্য পশ্চিমি শক্তিগুলির মতো জাপান কেবল আগ্রাসনের যুদ্ধ লড়ে না। তাদের প্রতিরক্ষা-কেন্দ্রিক সেনাবাহিনী অনেক ক্ষেত্রেই অন্যের উপর সরাসরি আক্রমণ না করে একটা সাধারণ ভারসাম্য রক্ষার কাজ করে। চিন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সে কথা একেবারেই প্রযোজ্য নয়। বর্তমান বিশ্বে এই দুই দেশকেই যথেষ্ট সন্দেহের চোখে দেখার কারণ আছে, বিশেষত ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে।

এক দিকে বেজিংকে আশ্বস্ত করা, ও অন্য দিকে চুপচাপ নিজেদের নৌবাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি— এই পথে এগোচ্ছে টোকিয়ো। সম্প্রতি আমেরিকা নির্মিত এফ-৩৫ ফাইটারের নৌসংস্করণ অবতরণে সক্ষম ডেস্ট্রয়ার যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। শত্রুকে ভয় দেখাতে ডেস্ট্রয়ারগুলির জুড়ি নেই। অবশ্য, বহু দূর থেকে দেশের জলভাগ নিয়ন্ত্রণ করার কাজেও লাগে এগুলি। জিবুতিতে সেনাঘাঁটি নির্মাণের সিদ্ধান্তও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ সেখানে ইতিমধ্যেই উপস্থিত আমেরিকা ও চিন। বোঝাই যাচ্ছে, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপান প্রতিরক্ষার চাবিকাঠিটি নিজের হাতে রাখতে চাইছে।

টোকিয়োর সঙ্গে তাল মেলানোর চেষ্টা করলে ভারতের মঙ্গল। এই জোট দু’দেশের পক্ষেই উপযোগী। জাপানের লগ্নিযোগ্য পুঁজি টানার ক্ষমতা বিপুল। বিচক্ষণ ভাবে মিত্রতাজাল বিস্তার করতে পারলে অর্থনীতি ও নিরাপত্তার স্বার্থে এই পুঁজি বিনিয়োগ ভারতও পেতে পারে। দিল্লি যে একেবারে এই পথে এগোয়নি তা নয়, কিন্তু বেজিংয়ের প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে পথটা নিয়ে কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতেও রয়েছে। সীমান্তে সেনার চাপ কমানোর ব্যাপারে বেজিংয়ের অনমনীয় দাবির ক্ষেত্রে ভারতকে খানিকটা নমনীয়তা দেখাতেই হবে। কিন্তু তার সঙ্গে টোকিয়োর সঙ্গে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-প্রতিরক্ষা জোটের তদবিরটাও করতে হবে, বেশ খোলাখুলি ভাবে এগিয়ে গিয়েই।

আসলে, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সুস্থিতি আনার জন্য চাই একটি শক্তপোক্ত ও নির্ভরযোগ্য ভূ-রাজনৈতিক শক্তিসমন্বয়। একই সঙ্গে, এ বার মলদ্বীপ-শ্রীলঙ্কায় যেমন দেখা গেল, ওই সব দেশে অস্থিতি থামাতেও দরকার হবে এই শক্তিজোট।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন