পরিবেশ সুন্দর রাখা আমারও কাজ

একদিকে বনসৃজন অন্যদিকে বৃক্ষছেদন। একদিকে জল ভরো, অন্যদিকে জলাশয় বুজিয়ে ফেলা, ভূগর্ভস্থ জলের অত্যধিক ব্যবহার। বাড়ির ছাদ থেকে রাস্তায় ময়লা ফেলা, আনাজের খোসা থেকে ন্যাপি কোনওটাই বাদ যায় না। লিখছেন শ্যামলকুমার হালদার।বছরের একটা দিন বিশ্বপরিবেশ দিবস হিসাবে পালন করলেও ধারাবাহিকতার অভাব অনেকটাই  পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share:

গাছ কেটে ফেলায় বিপন্ন পাখিরা। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম

‘পরিবেশ’ বলতে আমরা সাধারনত একটা প্রচলিত ধারনা নিয়েই চলার চেষ্টা করে থাকি। কম বেশি সকলেই এই বিষয়ে যতটা বলতে বা শোনাতে আগ্রহী থাকি সেই অনুপাতে কাজ করতে পারলে সামগ্রিক অর্থে ‘পরিবেশে’র উন্নতি সাধন হতে পারত।

Advertisement

বছরের একটা দিন বিশ্বপরিবেশ দিবস হিসাবে পালন করলেও ধারাবাহিকতার অভাব অনেকটাই পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। কেন জানি না মনে হয় একটু আন্তরিক হলেই ছোট ছোট ভাবে আমরা এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারি। সরকারি, বেসরকারি স্তরে যে ধরনের কাজ হচ্ছে তার দিকে একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেই অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যাবে। সামগ্রিক একটা প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি, পরিবেশ বান্ধব সমাজ গড়ে তোলার জন্য।

আমরা যে যেখানে আছি তাকে কেন্দ্র করে চতুর্দিকে তাকালেই একটা অবস্থানগত চেহারা এবং স্ব স্ব ভূমিকার একটা ছবি স্মরণ করতে পারব। কিছু বিষয় অবশ্যই নিয়ন্ত্রণের বাইরে আবার কিছু ক্ষেত্রে আমাদের সদিচ্ছার অভাবও রয়েছে।

Advertisement

বাড়ির ছাদ থেকে রাস্তায় ময়লা ফেলা, আনাজের খোসা থেকে ন্যাপি কোনওটাই বাদ যায় না। অনেকে প্রতিবাদ করলেও, অনেকের কোনও বিকার দেখা যায় না। আসলে যে মানসিকতা এখানে কাজ করে সম্ভবত সেটা হল রাস্তা জনগনের বা সরকারের, বাড়িটা আমার। বাড়ির নোংরা জল বা বাড়ির ছাদ থেকে এসি থেকে নির্গত জল পথচারীর মাথায় ফেলা কোনও দোষের নয়। এর মধ্যে গরিব, ধনী, শিক্ষিত, অশিক্ষত মানুষের মধ্যে কোনও বিভেদ সাধারনত দেখা যায় না। অল্প বিস্তর আমরা প্রায় সকলেই রাস্তা, পার্ক, স্টেশন, বা পাবলিক প্লেসগুলো নোংরা বর্জিত করে পরিষ্কার রাখার দায় অন্যের ঘাড়েই রাখতে পছন্দ করে থাকি। সরকারি বা বেসরকারি নানান বিধিনিষেধ গুলো উপেক্ষা করার একটা প্রবণতা আমাদের মধ্যে কাজ করে। আমরা একবার ভাবি না যে যা ইচ্ছে করুক। আমি আমার পরিবেশ নষ্ট করব না। কে বলতে পারে এই চেতনায় অন্যরা উৎসাহিত বোধ করবে না।

একদিকে বনসৃজন অন্যদিকে বৃক্ষছেদন। একদিকে জল ভরো, অন্যদিকে জলাশয় বুজিয়ে ফেলা, ভূগর্ভস্থ জলের অত্যধিক ব্যবহার। গাড়ির ধোঁয়া পরীক্ষার দোকান গজিয়ে ওঠা এবং জরিমানার বিধান অথচ ভ্যান গাড়ির রমরমা। নদী-নালা, কাঁদর, ধুঁকছে পরিচর্যার অভাবে। জলের ধর্ম অনুসারে বয়ে যাওয়ার পরিবর্তে জল দাঁড়িয়ে নোংরা আবর্জনা র মধ্যে আটকে যাচ্ছে। জন্ম নিচ্ছে মশা। ডেঙ্গি জাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে।

বড় বড় শহরগুলো শুধু নয় ছোট বড় মাঝারি প্রায় সব জায়গায় নয়ানজুলি নামক জলাশয় অবলুপ্ত। এখানে কিন্তু সাম্যের অভাব নেই বললেই চলে। ধনী, দরিদ্র, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, বেকার, সাকার প্রায় সকলেই নিজ বাড়ি সন্নিহিত সেই জলাশয়গুলি (যেগুলোর মালিকানা তাদের নয়) গাড়ির গ্যারাজ, বারান্দা, চায়ের দোকান করে নিয়ে নিসঙ্কোচে দিব্যি আছেন। গরীব মানুষগুলোর পেটের তাড়না না হয় বোঝা যায়, কিন্তু অন্যদের এই দখলদারি মনোভাবের কারণে জলের খামতি শুধু নয়, প্রয়োজনে (পাড়াতে কোথাও আগুন লাগলে) জলের অভাব দেখা যায়।

এয়ার হর্নের ব্যাবহারে কত মানুষকে দেখা যায় চোখেমুখে যন্ত্রণা নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে। কারণে অকারণে দানবীয় বাজনা রাত্রির সময়সীমা অতিক্রম করলেও অসহায় ভাবে মেনে নেওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়ে গিয়েছে আমাদের। সরকারি নিয়মে নির্দিষ্ট ডেসিবেল নির্ধারিত থাকা সত্ত্বেও এই যন্ত্রগুলো কীভাবে ছারপত্র পায়, তা অবশ্য ভেবে পাওয়া যায় না। প্লাস্টিক নিয়ে এত প্রচার, অথচ এর ব্যাবহারে কোনও ছেদ পরেনি। আমরা অভ্যস্ত হয়ে পরেছি ব্যাগ হাতে না বেড়িয়ে পলিপ্যাকে খরিদ দ্রব্য কিনে আনতে। অনেকটা নিজেকেই নিজে বঞ্চিত করার মতো ব্যাপার তাই নয় কি?

সবুজায়নের বদলে কংক্রিটের জঙ্গল পরিবেশের ভারসাম্যের ব্যাঘাত হয়তো ঘটাচ্ছে কিন্তু যেটুকু রক্ষা সম্ভব সেটাও করার একটা তাগিদ থাকা প্রয়োজন। কোথাও কোথাও দেখা যায় সবুজ নষ্ট করার একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়লে তার বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে অন্য জায়গায় গাছ লাগিয়ে ক্ষতিপূরণ করা হচ্ছে। বাড়ির মধ্যে দু’চারটি গাছ লাগালে তো ক্ষতি নেই। এতে আপনি যেমন উপকৃত হবেন তেমনি পরিবেশও।

বাস্তব সমস্যাকে উপেক্ষা করা যায় না। মানুষ বাড়ছে, বাড়ছে নানান চাহিদা, প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না, রাস্তা সম্প্রসারণ করতে গাছে হাত দিতে হতে পারে। কিন্তু যাঁরা অপ্রয়োজনে নিধন করেন তাঁদের কাজের কোনও ব্যাখ্যা নেই। দীর্ঘমেয়াদী ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক বিষয়টি থেকে তাঁরা কেউই যে মুক্তি পাবেন না এটা বোঝার পরিবেশ ও পরিস্থিতির দরকার রয়েছে। সমাজ নানান বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, ভাল মন্দ হাত ধরাধরি করে সামনে চলে আসছে। প্রলোভনে পা দিয়ে তাৎক্ষনিক লাভের আশায় আমরা হারিয়ে ফেলছি আসল লক্ষ্য।

পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব যাঁদের রয়েছে তাঁরাই শুধু ভাববেন এটা অত্যন্ত সরলীকরণ হয়ে যাবে। আমি আপনি প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে এই পৃথিবীকে সুন্দর করে তোলার, এই সত্যকে অস্বীকার করলে নিজেকেই অস্বীকার করার মতো হয়ে যায় না কি?

সারা বিশ্ব আজ পরিবেশ নিয়ে চিন্তিত। উষ্ণায়ন পৃথিবীর কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। ঋতু চক্রও যেন পালটে যাছে। প্রখর গরম অথবা অসহনীয় শীত, শরত হেমন্ত যেন হারিয়ে গিয়েছে, কোথাও অনাবৃষ্টি আবার কোথাও অতিবৃষ্টি।

এর পরেও বলা যেতে পারে সমাজ বিজ্ঞানীদের নিরন্তর প্রচেষ্টা, শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের ঐকান্তিক সদিচ্ছা, সরকারি বা বেসরকারি ভাবে নানান প্রচার ও সেমিনার এবং সর্বোপরি কিছু সমাজ পাগল মানুষের চেষ্টা আমাদের আশার আলো দেখায়। অনুপ্রাণিত হতে সাহায্য করে। ভাল লাগে যখন দেখি আমাদের মধ্যে কেউ অনর্গল পরে যাওয়া জলের কলের মুখ নিজে থেকেই বন্ধ করার জন্য এগিয়ে যান। অথবা কলা খেয়ে রাস্তায় খোসা ফেলা দেওয়া লোকটিকে বুঝিয়ে দেন কেন ফেলা উচিত নয়। যখন দেখি ট্রেনে-বাসে ধূমপান করতে মানুষ ইতস্তত বোধ করছেন। ছোট বাচ্চারা নিজের হাতে গাছ লাগাচ্ছে। সদিচ্ছা এখানে সবচেয়ে বড় অনুঘটকের কাজ করে। সামগ্রিক পরিবেশ দূষণের ভয়ঙ্কর চাপের কাছে শুধুমাত্র সরকারি ব্যাবস্থা যথেষ্ট নয়। সমাজের একটা অখণ্ড অংশ হিসাবে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। ব্যাক্তিগত স্তরে সজাগ থেকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে সামান্য ভুমিকা পালন করতে হবে। পৃথিবীটাকে সুন্দর করে তোলার দায়িত্ব আমাদেরও। ‘চ্যারিটি বিগিন্স অ্যাট হোম’। দোষারোপ নয় দায়িত্ববান হয়ে উঠুক নাগরিক সমাজ।

লেখক প্রাক্তন ব্যঙ্ককর্মী,

মতামত নিজস্ব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন