প্রবন্ধ ২

মেহবুবার কাজটা কিন্তু বেশ কঠিন

জম্মু ও কাশ্মীরে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পথ থেকে সরে আসা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে নেওয়া মোটেই বাঞ্ছিত নয়। সুতরাং অনেক বাধা কাটিয়ে মেহবুবা মুফতি বিজেপি-পিডিপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হলেন। মূলধারার রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার দুই দশক পরে মেহবুবা মুফতি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটির সামনে দাঁড়ালেন। মাসতিনেক ‘ভাবনাচিন্তা’-র পর তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসার সিদ্ধান্ত করলেন। জানুয়ারির সাত তারিখে তাঁর বাবা মুফতি মহম্মদ সৈয়দ প্রয়াত হওয়ার পর রাজ্যটি রাজ্যপালের শাসনে চলছিল।

Advertisement

সুজাত বুখারি

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০০
Share:

মূলধারার রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার দুই দশক পরে মেহবুবা মুফতি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটির সামনে দাঁড়ালেন। মাসতিনেক ‘ভাবনাচিন্তা’-র পর তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসার সিদ্ধান্ত করলেন। জানুয়ারির সাত তারিখে তাঁর বাবা মুফতি মহম্মদ সৈয়দ প্রয়াত হওয়ার পর রাজ্যটি রাজ্যপালের শাসনে চলছিল।

Advertisement

তাঁর দল পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ২০০২ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত কাশ্মীরে ক্ষমতায় ছিল। ২০১৫ সালেও মাস দশেক তাঁদেরই সরকার ছিল। কিন্তু, এযাবৎকাল মেহবুবা কার্যত সরকারের বাইরেই থেকে গিয়েছেন। তিনি নিজেই চেয়েছিলেন, রাজ্য শাসনের দায়িত্বটি তাঁর বাবা নিন। বাবা মুফতি মহম্মদ সৈয়দের সঙ্গে ১৯৯৯ সালে তিনি যে পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন, তার সাংগঠনিক কাজেই সময় ব্যয় করেছেন মেহবুবা।

তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হলেন। তিনি যে এই দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হয়েছেন, তাঁতে অনেকেই বিস্মিত। কারণ, তিনি মাসতিনেক ধরে যে শুধু জোটসঙ্গী বিজেপি-কেই ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, তা নয়, নিজের দলের নেতাদের সামনেও বেশি কিছু ভেঙে বলেননি। তিনি যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রিত্বে রাজি হওয়ার সিদ্ধান্তটি করলেন, তাতে নাটকীয়তা প্রচুর। ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখ তিনি যখন রাজ্যপাল এন এন ভোরা-র সঙ্গে দেখা করেন, তখন কেন্দ্রীয় সরকারের সামনে কয়েকটি শর্ত পেশ করেন। জানান, ভরসার পরিবেশ তৈরি করার জন্য এই শর্তগুলি পূরণ হওয়া জরুরি। বিজেপি ও পিডিপি-র মধ্যে খিড়কির দরজা দিয়ে আলোচনা চলছিল বটে, কিন্তু সেই আলোচনাও তেমন ফলপ্রসূ হচ্ছিল না। মেহবুবার সঙ্গে জোটের আলোচনায় বিজেপি-র প্রধান মুখ ছিলেন রাম মাধব— সঙ্ঘ পরিবার থেকে যাঁকে দলের সাধারণ সম্পাদক করে নিয়ে এসেছে বিজেপি। ১৮ মার্চ তিনি পিডিপি-র সঙ্গে আলোচনার দরজাটি কার্যত বন্ধই করে দেন; বলেন, জোট বাঁচানোর জন্য কোনও পূর্বশর্ত তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। রাম মাধবের এই উক্তির আগের দিনই মেহবুবার সঙ্গে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ-র আলোচনা হয়েছিল। আর, সে দিনই নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল মেহবুবার।

Advertisement

ক্ষুব্ধ মেহবুবা শ্রীনগরে ফিরে গেলেন। দিল্লিতে বিপদঘণ্টা বেজে উঠল। শ্রীনগরে গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় না থাকলে মুশকিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বললেন, নরেন্দ্র মোদীর সম্ভাব্য মার্কিন সফরে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে যে সাক্ষাৎ হওয়ার কথা, তখন জম্মু-কাশ্মীরে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি থাকলে ভাল দেখাবে না। অন্য দিকে, সেনাবাহিনীও নাকি ক্ষমতার মুখ হিসেবে অসামরিক লোকই চাইছিল, কারণ কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতা ও উগ্রপন্থীদের প্রতি সমর্থন, দুই-ই বাড়ছে। মোদী ও মেহবুবার বৈঠকে কোনও গোপন বোঝাপড়া হয়েছিল কি না, হলে তার শর্তগুলি কী ছিল, তা জানা যায়নি। কিন্তু মেহবুবা জানালেন, বৈঠকটি ‘ইতিবাচক’ হয়েছে, তিনি মোদীর আশ্বাসে সন্তুষ্ট। বিজেপি ও পিডিপি-র জোট উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে নির্ধারিত যে শর্তগুলির ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল, মেহবুবা চেয়েছিলেন, সেই শর্তগুলি মেনে চলা হোক, কোনও দশ পাতার নথি নয়। সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন কবে প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে, কাশ্মীরে বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি কবে ফিরবে, পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতা কী ভাবে হবে, এমন প্রবল বিতর্কিত প্রশ্নগুলির ক্ষেত্রেও তিনি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার পক্ষপাতী।

মেহবুবা নিঃসন্দেহে ল়ড়াকু নেত্রী। কিন্তু সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। সরকার কী ভাবে কাজ করে, তাঁকে শিখতে হবে। বহু ক্ষেত্রেই তিনি তৃণমূল স্তরের সমস্যাগুলি বুঝতে পারেন, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে দিয়ে কী ভাবে সেই সমস্যার সমাধান করা সহজ কাজ নয়। জানুয়ারি থেকে তিন মাস জম্মু-কাশ্মীরে রাজ্যপালের শাসন চলার সময় আমলাতন্ত্র বেশ দক্ষ ভাবেই কাজ করেছে বলে স্থানীয়দের মত। সরকার ক্ষমতায় থাকলে আমলাদের থেকে এই সহযোগিতা পাওয়া যায় না। ফলে, সাধারণ মানুষের ধারণা হয়েছে, সরকারের চেয়ে রাজ্যপালের শাসন ভাল। কাজেই, মেহবুবার কাজটি কঠিন। তাঁকে সুশাসন দিতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার পাশাপাশি দুর্নীতিও সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়। মেহবুবা তাঁর প্রশাসনকে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ করে তুলতে পারেন কি না, প্রশাসনকে স্বচ্ছ করতে পারেন কি না, মানুষ সে দিকে নজর রাখবে। তিনি যদি গুরুত্বপূর্ণ পদে আমলা নিয়োগের সময় রাজনৈতিক সমীকরণের কথা মাথায় রাখেন, তবে তাঁর বাবার সঙ্গে তাঁর আর কোনও ফারাক থাকবে না। মুফতি মহম্মদ সৈয়দ দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর নৈতিক অধিকার হারিয়েছিলেন।

সংবাদমাধ্যমের কথা বিশ্বাস করলে বলতে হয়, তাঁর দলের কিছু বিধায়ক পিডিপি ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছিলেন। দিল্লির তূণের শেষ অস্ত্র ছিল এই বিধায়করাই। প্রশ্ন হল, মেহবুবা এই বিধায়কদের সঙ্গে কী করবেন? তিনি কী ব্যবস্থা করেন, কী ভাবে করেন, সব কিছুই কিন্তু নেতা হিসেবে তাঁর দক্ষতার পরিমাপ হিসেবে বিবেচিত হবে। জোটসঙ্গী বিজেপি-কে সামলানোও খুব সহজ হবে না। নেতা হিসেবে তাঁর ভাবমূর্তি এবং প্রবীণত্ব মুফতি মহম্মদ সৈয়দকে কিছু সুবিধা করে দিয়েছিল, সংশয় নেই। তাঁর আমলের বিজেপি আর মেহবুবার সরকারের বিজেপি কিন্তু এক নয়। মেহবুবার কাজটা এক অর্থে ভারসাম্য রক্ষার— এক দিকে তাঁকে বিজেপি-কে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে; অন্য দিকে, নিজের কর্তৃত্বও প্রতিষ্ঠা করে রাখতে হবে, যাতে তাঁকে তাচ্ছিল্য করার সাহস জোটসঙ্গীদের না হয়। বিজেপি বিধায়কদের সঙ্গে কোনও সমস্যা তৈরি হলে নরেন্দ্র মোদীর সমর্থন মেহবুবার দিকে থাকে কি না, তা-ও জরুরি প্রশ্ন।

বিজেপি-র সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের গতিপথের ওপরও নজর থাকবে গোটা রাজ্যের। বিজেপি-র সঙ্গে পিডিপি জোট গড়া ইস্তক অভিযোগ উঠেছে, তাঁরা সঙ্ঘ পরিবারের জন্য কাশ্মীরের দরজা খুলে দিলেন। মেহবুবাকে নিজের রাজনৈতিক জমিটি বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কাশ্মীরের সমস্যার সমাধানে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষমতা এমনিতে সীমিত। কিন্তু মেহবুবা দক্ষ প্রশাসন দেওয়ার পাশাপাশি বিজেপি-কেও সামলে রাখছেন কি না, সংবিধানের ৩৭০ ধারা, কাশ্মীরে দুই পতাকা অথবা গোমাংস ভক্ষণের মতো প্রশ্নগুলি ওঠা বন্ধ করতে পারছেন কি না, রাজ্যবাসী সে দিকে নজর রাখবেন। তাঁর বাবার আমলে বিজেপি যেমন এই প্রশ্নগুলি তোলার মতো ছাড় পেয়েছিল, মেহবুবাও তাঁর জোটসঙ্গীকে ততখানি জমি ছাড়েন কি না, সেটা প্রশ্ন। কেন্দ্র কাশ্মীরের জন্য দরাজ হাতে টাকা দেয় কি না, বিজেপি মেহবুবা মুফতির কথা শুনে চলে কি না, অদূর ভবিষ্যতেই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যাবে। কিন্তু, মেহবুবা যে নিজের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকিটি বিজেপিকে জোটসঙ্গী
করে জম্মু-কাশ্মীরের মসনদে বসে নিলেন, সে বিষয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশই নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন