বিলুপ্তির পথে। কলকাতার ‘নিজস্ব’ শৈলী।
আমার জন্ম কলকাতায়, কিন্তু আমার যখন বছর দেড়েক বয়েস, সেই সময় আমরা বম্বে চলে গিয়েছিলাম। সেটা সম্ভবত ১৯৬৪ সালের গোড়ার দিক। যে কোম্পানিতে আমার বাবা কাজ করতেন, সেটির সদর দফতর শ্রমিক সংক্রান্ত অশান্তির ফলে কলকাতা থেকে বম্বেয় সরে যায়। এ-রকম আরও অনেক শিল্পসংস্থাই তখন এই কারণে কলকাতা ছেড়েছিল। এর পরেও বছরে এক বার অন্তত আমরা কলকাতায় আসতাম, কখনও দু’বারও। আমার মামা থাকতেন ভবানীপুর অঞ্চলে, ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত প্রতাপাদিত্য রোডে। তিনি ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার— যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে জার্মানি। আমি যখন একটু বড় হয়েছি, তত দিনে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে কয়েক জন বন্ধুর সঙ্গে হাওড়ায় একটি যন্ত্রপাতি নির্মাণের কারখানা তৈরি করেছেন। রাজনৈতিক ডামাডোলের সেই যুগে কারখানাটি কিছুতেই দাঁড় করানো যায়নি। আমার মামা অবশ্য কোনও দিন বামপন্থায় তাঁর বিশ্বাস হারাননি।
কলকাতায়, বিশেষ করে মামার বাড়িতে যাওয়া-আসার ফলে আমি দুটো জিনিস শিখেছিলাম। এক, বম্বের যে কর্পোরেট জগৎ দেখে আমি অভ্যস্ত, তার থেকে অন্য রকম পৃথিবীও আছে, ইংরেজিয়ানা ছাড়াও একটা উচ্চ মানের এবং আকর্ষণীয় সংস্কৃতি থাকতে পারে। বস্তুত, তখন মনে হত, ইংরেজিয়ানার বলয়ের বাইরে যে ভারত, সাংস্কৃতিক ভাবে সেটাই বরং সচরাচর বেশি উন্নত এবং আকর্ষণীয়। দুই, সে দিন আমাদের এই ধারণাও হয়েছিল যে, শিক্ষা ও সংস্কৃতি কেবল সম্পন্ন, সুবিধাভোগী এবং আর্থিক ভাবে সুস্থিত হওয়ার উপর নির্ভর করে না। বস্তুত, আমার মামার বাড়িতে উল্টোটাই সত্য বলে মনে হত।
মামার সম্পত্তি বলতে ছিল শ্বশুরের দেওয়া ওই বাড়িটি। আমাদের পরিবার সিলেট থেকে এ পারে আসেন, যেটুকু যা ছিল সবই তাঁরা দেশভাগের সময় খুইয়েছিলেন। তাই মামা যে ধরনের বাড়িতে থাকতেন, আমার সেটিকে বিশেষ কোনও সুবিধাভোগের ব্যাপার বলে মনে হয়নি। তা ছাড়া, ষাটের দশকে পৌঁছে প্রতাপাদিত্য রোডের সেই আগের গরিমা আর ছিল না, কিছুটা অভাবগ্রস্ত এবং বেশ অস্থির একটা এলাকা হয়ে পড়েছিল সেটি। কিন্তু ওই বাড়িতে যে পরিসর এবং জীবন ছিল, তার অন্দরমহলে যে সমাজের ইতিবৃত্ত বয়ে চলত, আমি পরবর্তী জীবনে পৃথিবীর অন্য নানা জায়গায় তার প্রতিধ্বনি খুঁজে পেলেও ঠিক সেই জিনিসটা আর কোথাও পাইনি। উদাহরণ হিসেবে বাড়িটির কয়েকটা বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে পারি: একতলায় দেউড়ি; লালপাথরের মেঝে; সবুজ রঙের কাঠের খড়খড়িওয়ালা ভেনিশিয়ান বা ফ্রেঞ্চ উইন্ডো; দরজায় দরজায় গোল কড়া; কাঠের খিল; খোলা ছাদ; নকশা-কাটা লোহার রেলিং দেওয়া দোতলার লম্বা বারান্দা; সূক্ষ্ম কারুকাজ করা কার্নিশ; দেওয়ালে চমৎকার নকশা করা ছিদ্র সংবলিত ভেন্টিলেটর, যার মাপ খোলা হাতের তালুর সমান। (চল্লিশের দশকের কিছু কিছু বাড়িতে খুব চনমনে আর্ট-ডেকো নকশা দেখা যেত: অর্ধবৃত্তাকার ব্যালকনি; সিঁড়ির গহ্বরে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত একটা খাড়া কাচের দেওয়াল; গ্রিল এবং গেটে প্রসিদ্ধ সূর্যোদয়ের মোটিফ।)
বাড়িটা এখন আর নেই। ১৯৯০-এর দশকে— পশ্চিমবঙ্গে শিল্প নিয়ে আসার জন্য বামফ্রন্টের তৎপরতা শুরু হয়নি, কিন্তু বাতাসে তার পূর্বাভাস মিলছে— সেই সময় কলকাতায় জমি-বাড়ির বাজারে স্ফীতি দেখা গিয়েছিল, এবং তার অভিঘাতেই প্রতাপাদিত্য রোডের বাড়িটি ভাঙা পড়ল। এখানে বলা দরকার যে, শহরের অর্থনীতিতে তখন ভাটার টান, গৃহস্বামীদের অনেকের পক্ষেই বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করা সাধ্যাতীত হয়ে পড়ছিল এবং নতুন প্রোমোটার-ডেভেলপাররা সেই সুযোগে পুরনো বাড়িগুলি কিনে ফেলছিলেন। শিল্প আসেনি— জমি অধিগ্রহণের জটিল সমস্যা আর পশ্চিমবঙ্গের দুর্মর পপুলিস্ট রাজনীতি শিল্পায়নের পথে দুস্তর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ‘ডেভেলপার’দের দাপটে বাড়ির পর বাড়ি, পাড়ার পর পাড়া ধূলিসাৎ হতে থাকল। এদের মধ্যে অনেকে আসলে এক নতুন প্রজাতির জমি-লুঠেরা, এদের নীতি হল: ভাল জায়গায় বাড়ি পেলেই কিনে নাও এবং তা ভেঙে ফেলে বহুতল ইমারত তৈরি করো। এরা পুরনো বাড়িগুলো কিনেছিল কার্যত জমির দামে, কখনওই বাড়ির সত্যিকারের দাম যাচাইয়ের কোনও চেষ্টাই হয়নি। আর বাড়িগুলোর কাঠামো বজায় রেখে নতুন নির্মাণের তো কোনও কথাই ওঠেনি। পুরনো বাড়ি কেনা, তা ভাঙা এবং নতুন বাড়ি তৈরি, সবটাই চলেছে একেবারে কালক্ষেপ না করে।
জমি-বাড়ির বাজারে সেই স্ফীতি অনেক দিন শেষ হয়েছে। এখন ফাটকা কারবারের খেলায় নতুন সম্পত্তির দাম বাড়ে। তার মানে, বসবাসের চাহিদার টানে নয়, লগ্নির উপায় হিসেবে এখন নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে— আগে যে টাকা লোকে শেয়ার কিনে বা অন্য ভাবে বিনিয়োগ করত, আজকাল সেটা বাড়ি কিনে করছে। ইদানীং অন্য জিনিসের তুলনায় সম্পত্তিতে টাকা রাখা বেশি নিরাপদ মনে হয়েছিল। কিন্তু কলকাতায় সম্পত্তির দাম এখন একটা স্থিতাবস্থায় পৌঁছেছে, প্রোমোটার এবং দালালরা ছাড়া এই বাজারে কারও বিশেষ লাভ হচ্ছে বলে মনে হয় না। মাস দুয়েক আগে সংবাদপত্রে একটা খবর দেখেছি যে, কলকাতায় মাল্টিমিলিয়নেয়ারের সংখ্যা আশ্চর্য ভাবে বেড়েছে, অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি দিয়ে যে বৃদ্ধির অঙ্ক মেলানো যায় না। মনে রাখতে হবে, এঁরা ডলারের অঙ্কে মাল্টিমিলিয়নেয়ার, টাকার অঙ্কে নয়। ওই রিপোর্টে এ কথাটাও ছিল যে, এঁদের অধিকাংশেরই রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা।
গত কুড়ি বছরে ইউরোপে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে আমি একটি কথা উপলব্ধি করেছি। সেখানে বিভিন্ন শহরে আমরা কেবল তাদের ইতিহাসকেই খুঁজে পাই না, জানতে পারি, সেই ইতিহাস মুছে দেওয়ার চেষ্টা কী ভাবে প্রতিহত করা হয়েছিল এবং ইতিহাস রক্ষার সেই উদ্যোগে স্থানীয় সমাজ কী ভাবে শামিল হয়েছিল। এই উদ্যোগ না হলে দুনিয়ায়— ইউরোপে, অস্ট্রেলিয়ায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, এমনকী ল্যাটিন আমেরিকায়— গত দুই শতাব্দীর নগরায়ণের ইতিহাস আজ আর বিশেষ অবশিষ্ট থাকত না। কলকাতা ছিল এই নগরায়ণের বিশ্ব-ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অনন্য শরিক। ‘অনন্য’ বলছি, কারণ আমি যে ধরনের বাড়ির বর্ণনা দিলাম, ভারতে বা ভারতের বাইরে তার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ঠিক সেই ধরনটা আর কোথাও মিলবে না। কলকাতার স্থাপত্যের কথা উঠলেই আমরা সচরাচর দু’ধরনের ইমারতের কথা ভাবি: এক, ব্রিটিশদের তৈরি ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠান এবং দুই, উত্তর কলকাতার অভিজাত পরিবারের নিজেদের তৈরি বসতবাড়ি। কিন্তু আমি যে বাড়িগুলির কথা বলছি, সেগুলি মধ্যবিত্ত বৃত্তিজীবী বাঙালির বাড়ি: উকিল, ডাক্তার, আমলা, অধ্যাপক, এই ধরনের মানুষের থাকার জন্য এই সব বাড়ি তৈরি হয়েছিল, যাঁরা তৈরি করেছিলেন তাঁদের নাম হারিয়ে গেছে। অনেক বিষয়ে বাড়িগুলির মধ্যে মিল আছে, যেমন ফ্রেঞ্চ উইন্ডো, কার্নিশ, লাল মেঝে, যেগুলির কথা আমি বলেছি। কিন্তু কোনও দুটি বাড়ি হুবহু এক রকম নয়। এর ফলে একটা অভূতপূর্ব ব্যাপার ঘটেছিল: একই পাড়ায়, একই রাস্তার ওপর একই ঘরানার, অথচ খুবই বৈচিত্রপূর্ণ অনেক বাড়ির সমাবেশ দেখা গিয়েছিল। এবং তাদের শৈলীকে বড়জোর বঙ্গীয়-ইউরোপীয় বলা যেতে পারে, সেটা রেনেসাঁস ধারার নয়, মুম্বইয়ের ঔপনিবেশিক ইমারতগুলির মতো নিয়ো-গথিক নয়, ইন্দো-সারাসেনিক তো নয়ই। অমর্ত্য সেনের ভাষায় বললে, শৈলীটি ‘খ্যাপাটে’ এবং সুন্দর, আর তা পুরোপুরি বাঙালি মধ্যবিত্তের নিজের। এই বাড়িগুলিকে ‘পুরনো’ বললে মস্ত ভুল হবে, সেগুলি ‘নতুন’ কলকাতার অবদান, আধুনিকতা এবং আধুনিকবাদের যে কলকাতা উনিশ শতকে উঠে এসেছিল, যা ছিল একই সঙ্গে ব্রিটিশ কলকাতা এবং দেশজ ‘ব্ল্যাক টাউন’-এর থেকে আলাদা এবং তাদের বিপরীত, তাদের থেকে সাংস্কৃতিক রসদ সংগ্রহ করলেও তাদের অতিক্রম করে যেতে পেরেছিল এই নতুন কলকাতা।
এই কলকাতারই বাড়িগুলি ধ্বংস হতে বসেছে। তাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমরা কেউ কেউ সওয়াল করছি। (মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দুটি চিঠি প্রেরিত হয়েছে: একটিতে স্বাক্ষর করেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের পনেরো জন নাগরিক, কোনও বিশেষ দলমতের সীমায় যাঁদের বেঁধে ফেলা যায় না, অন্য চিঠিটি আমাকে অমর্ত্য সেনের লেখা, যেখানে তিনি আমাদের উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছেন।) সরকারের কাছে পেশ করা একটি প্রস্তাব হল নির্মাণের অধিকার হস্তান্তর (ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইটস)। ব্যাপারটা এই রকম: বাড়ির মালিক সেই বাড়ির জমির দামের বিনিময়ে নির্মাণের ‘অধিকার’ বিক্রি করবেন, সেই অধিকারের জোরে অন্য জায়গায় সমমূল্যের নির্মাণকাজ করা যাবে, ফলে মূল বাড়িটি রক্ষা পাবে। এই মডেল বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে, সেটা আগে থেকে বলা কঠিন, চেষ্টা করে দখতে হবে।
এই উদ্যোগ নিয়ে এগোনো সহজ হয়নি। সেটা শুধু সরকারি অনাগ্রহের কারণে নয়। পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন এবং কলকাতা পুরসভার হেরিটেজ কমিটির হাতে কোনও কার্যকর ক্ষমতা নেই, কিন্তু সেটা একমাত্র বাধা নয়। যেটা বুঝে ওঠা আরও কঠিন, তা হল, এক শতাব্দীর বেশি সময় কলকাতার নাগরিকরা স্থাপত্যের যে ঐতিহ্য স্বাভাবিক উত্তরাধিকার হিসেবে জেনে এসেছেন, তার মর্ম তাঁরা উপলব্ধি করেন না এবং যে ইতিহাস এই ঐতিহ্য ও তার পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছিল তা থেকেও তাঁরা আশ্চর্য ভাবে বিচ্ছিন্ন। এই কারণেই আমি এই লেখার শুরুতে কিছুটা ব্যক্তিগত কথা বলেছি, যাতে আমার বাইরে-থেকে-দেখার চোখটাকে বোঝা যায়। এই ঐতিহ্য নিয়ে বাঙালির একটা বিশেষ স্মৃতিমেদুরতা আছে, বাংলা ব্যান্ডের নানা গানে বা সাম্প্রতিক নানা বাংলা চলচ্চিত্রে যার প্রকাশ ঘটেছে। এ সব সৃষ্টিতে অনেক সময়েই উত্তর কলকাতা এবং তার কোনও না কোনও পুরনো জীর্ণ বাড়িকে শহরের ‘প্রকৃত উত্তরাধিকার’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আমি এই ধরনের কোনও অনুভূতির শরিক নই বলেই হয়তো বাড়িগুলিকে আমার মতো করে দেখতে পারি। আমি এমন অনেককে জানি, যাঁরা এই স্থাপত্যগুলিকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন না, তাঁদের মতে কোনও বুদ্ধিমান লোকের এ-সব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও কারণ নেই। কিন্তু তাঁদের চেয়েও ওই স্মৃতি-বিলাসীদের আমার আরও দূরবর্তী মনে হয়, তাঁরা যেন একটা নিরুত্তাপ অনাগ্রহে যা হচ্ছে তাকে মেনে নিয়েছেন।
শহরের পুনরুজ্জীবনের প্রশ্নটা মূল্যবান। অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের সঙ্গে তার সংযোগ আছে, কিন্তু তার একটা স্বাতন্ত্রও আছে। যে কোনও শহরের নতুন করে সজীব হয়ে ওঠার একটা শর্ত হল এই যে, তার পরিসর, ইমারত এবং ইতিহাসকে নাগরিকরা অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করবেন না, সেগুলি নিয়ে ভাবিত হবেন, এবং সেগুলিকে বুঝবেন, তাদের পুনর্ব্যবহার করবেন। গত দু’দশকে কলকাতা এই কাজটিতে মোটের উপর ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু সমস্ত বড় শহরের ইতিহাসেই এমন ব্যর্থতার নজির আছে, যে ব্যর্থতা বুঝতে পেরে তারা আবার নিজেকে নতুন করে দেখতে শেখে।