সম্পাদক সমীপেষু

জয়ন্ত ঘোষাল যথার্থ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এ রাজ্যে তবে শিল্পের বদলে গানের জলসা, সিন্ডিকেট আর তোলাবাজিই ভবিতব্য।’ (‘শিল্প আমরা করব না’, ১-২)। এ প্রসঙ্গে রাজ্য সরকার তথা রাজ্যবাসীকে খেয়াল করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, অদূর ভবিষ্যতে ভিনরাজ্য এবং ভিনদেশে বহিরাগতদের কর্মসংকোচন ঘটার প্রবল সম্ভাবনা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share:

এককালীন ক্ষতিপূরণের বদলে বন্ড

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল যথার্থ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এ রাজ্যে তবে শিল্পের বদলে গানের জলসা, সিন্ডিকেট আর তোলাবাজিই ভবিতব্য।’ (‘শিল্প আমরা করব না’, ১-২)। এ প্রসঙ্গে রাজ্য সরকার তথা রাজ্যবাসীকে খেয়াল করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, অদূর ভবিষ্যতে ভিনরাজ্য এবং ভিনদেশে বহিরাগতদের কর্মসংকোচন ঘটার প্রবল সম্ভাবনা। উপরন্তু রাজ্যের চাষি পরিবারের ছেলেরা চাকরি চাইছে, চাষে ফিরতে চাইছে না। এই সব পরিবারের মেয়েরাও চাকরিতে আগ্রহী। এই পরিস্থিতিতে শিল্প গড়া ছাড়া সমস্যার স্থায়ী কোনও সমাধান নেই। ভাঙড়কাণ্ড যে তিনটি শিক্ষা দিয়ে গেল, তার প্রথমটি হল: শিল্প ও পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য কৃষিজমির প্রয়োজন হলে সে জমি কেবলমাত্র সরকারেরই অধিগ্রহণ করা উচিত। নচেৎ জমি মাফিয়াদের হাতে চাষিকে সর্বস্বান্ত হতে হবে। দ্বিতীয় শিক্ষা, চাষির সম্মতিতে সমকালীন বাজারমূল্যে বা তার কিছু বেশি দিয়ে জমি অধিগ্রহণ করলেও দু’তিন বছর বাদে শিল্প স্থাপনকালে ওই জমিদাতারা প্রতিবাদী হয়ে উঠবেন। কারণ, উন্নয়নের সম্ভাবনায় তত দিনে ওই অঞ্চলে জমির দাম কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। তখন জমিদাতারা নিজেদের বঞ্চিত বোধ করতে থাকেন। কারণ, যে চাষিরা আগে জমি দেননি বর্তমান মূল্যবৃদ্ধি থেকে তাঁদের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা জমিদাতাদের চেয়ে বেশি। উপরন্তু জমি বেচে যে টাকাটা জমিদাতারা পেয়েছিলেন তার বেশ কিছুটা ভোগ্যপণ্য ও সামাজিক ব্যয় ইত্যাদিতে খরচ হয়ে গিয়েছে। তৃতীয় শিক্ষা, সুযোগসন্ধানী বিরোধী রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী চাষির ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের পালে বাতাসের জোগান দিতে চাইবে।

তা হলে সমস্যার সমাধান কী? চাষিকে ভবিষ্যতের দাম দেওয়া হবে কী ভাবে? অন্তত কাগজেকলমে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সমাধান হল: অধিগৃহীত জমির পরিবর্তে জমির মালিক ও বর্গাদারকে সরকারি গ্যারান্টিযুক্ত ল্যান্ডবন্ড (Land Bond) দেওয়া। দুটি শর্ত এই বন্ডের জনপ্রিয়তা বাড়াবে এবং চাষিকে ভবিষ্যতে প্রতিবাদী করবে না। এক, জমির দাম যে হারে বাড়বে, বন্ডের দামও সেই হারে বাড়বে। দুই, ওই বন্ড সরকারকে না বিক্রি করে নিজের কাছে ধরে রাখলে ডিভিডেন্ড হিসাবে পাওয়া যাবে চাষ থেকে এত কালের বাৎসরিক আয়ের সমপরিমাণ বা কিছু বেশি টাকা। জমির দাম যত দিন উর্ধ্বমুখী তত দিন চাষি চেষ্টা করবেন বন্ড ধরে রেখে তার ডিভিডেন্ড থেকে সাংসারিক খরচ নির্বাহ করতে। তবুও বিবিধ প্রয়োজনে কিছু বন্ড প্রতিবছর কয়েক শতাংশ চাষিকে ভাঙাতে হবে। আনুমানিক পাঁচ শতাংশের মতো বন্ডের দাম হয়তো প্রতি বছর সরকারকে মেটাতে হবে। অর্থাৎ, সময় যত গড়াবে বন্ডের দাম তত বাড়বে ঠিকই, কিন্তু চাষির হাতে থাকা বন্ডের সংখ্যা তত কমবে। এই বন্ড ব্যবস্থায় গরিব চাষির স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে যে শর্ত প্রয়োজন তা হল ল্যান্ডবন্ডের মূল মালিক বা তাঁর অবর্তমানে তাঁর আইনসম্মত উত্তরাধিকারী ছাড়া তৃতীয় কোনও ব্যক্তি বা সংস্থার কাছ থেকে সরকার ওই বন্ড কিনবে না। অর্থাৎ জমি মাফিয়া নতুন করে বন্ড মাফিয়া হওয়ার সুযোগ পাবে না।

Advertisement

ভবিষ্যতের দাম দেওয়ার গ্যারান্টির বিনিময়ে যদি রাজ্যের দশটি অঞ্চলে হাজার দশেক একর জমি অধিগ্রহণ করে কিছু ভারী ও মাঝারি শিল্প গড়া হয়, রাজ্যের শিল্পায়নের চিত্রটা চিরতরে পাল্টে যাবে। অপ্রয়োজনীয় খরচে কাটছাঁট করে রাজ্য সরকার কি বন্ড বাবদ চাষিকে ভবিষ্যতে দুটো পয়সা বেশি দেওয়ার ঝুঁকি নিতে পারবে না?

মানসেন্দু কুণ্ডু। সামার ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া

আপত্তি আগেই ছিল

ভাঙড়ে পাওয়ার গ্রিড হবে না, ঘোষণার পরও কেন ভাঙড় অগ্নিগর্ভ হল? এই প্রশ্ন প্রশাসনের, জনগণের নয়। ভাঙড়বাসী না চাইলে পাওয়ার গ্রিড হবে না— কথাটা শুনতে ভাল। ‘চাষিদের জমি জোর করে কেড়ে নেওয়া হবে না’— এই সরকারি প্রচার ও বাস্তব এক নয়। ভাঙড়বাসী তো প্রথম থেকেই প্রতিবাদ করে আসছে। তা হলে এত দিন ধরে পাওয়ার গ্রিডের কাজ চলল কী করে? আজ যখন এলাকাবাসীর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল, এলাকা অশান্ত হল, দু’জনের প্রাণ গেল, বহু মানুষ আহত হল, এলাকা ছাড়া হল, তখন সরকার পিছু হটল। যে কোনও সরকার সংগঠিত আন্দোলনকেই সমীহ করে। বামফ্রন্ট আমলেও (সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম) তা-ই দেখেছি। পাওয়ার গ্রিডের কাজ অনেকটা এগিয়ে বন্ধ হয়ে গেল। এর ফলে ওই জায়গাগুলি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ল। এর জন্য দায়ী সরকারের অপদার্থতা। গত বামফ্রন্ট সরকারের অপদার্থতার জন্য সিঙ্গুরে না হল কারখানা, না হল চাষ। অথচ বহু মানুষকে জমি থেকে উৎখাত করা হয়েছিল। ফলে, প্রতিটি সরকারের উচিত পেশির জোর না দেখিয়ে, গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার না করে, এলাকাবাসীদের মনোভাবটা বোঝা। না হলে এক দিন তাকে খেসারত দিতেই হবে। এই কারণেই সিপিএম পরিচালিত বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। শুনলাম, ভাঙড়ের ঘটনার জন্য নাকি সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি খুবই উদ্বিগ্ন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের অতীত ভুলে আজ যখন বামপন্থীরা ফের সাধু সাজছেন, তখন জনগণের বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, তাঁরা আবার ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছেন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে কংগ্রেস এবং বিজেপির কোনও ভূমিকা ছিল কি না, জনগণ জানে। দিল্লিতে ক্ষমতায় থাকাকালীন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের অত্যাচার ঠেকাবার জন্য কংগ্রেস কিছুই করেনি।

আর একটি প্রশ্ন: বহিরাগত কারা? বামফ্রন্ট সরকারও সংগঠিত আন্দোলন দেখা দিলেই ‘বহিরাগত’ কথাটি ব্যবহার করত। এতে এলাকাবাসীকে বা আন্দোলনকারীদের অপমান করা হয় বলে আমার ধারণা। দেশের মানুষ বহিরাগত, না বাংলাদেশ-পাকিস্তান সহ বিদেশিরা বহিরাগত? নেতাজি-গাঁধীজিরা সারা দেশে ঘুরে আন্দোলন সংগঠিত করতেন। তাঁরা কি দেশের মধ্যে কোনও স্থানে বহিরাগত ছিলেন? মাদার টেরিজা, ভগিনী নিবেদিতারা বিদেশিনী হয়েও কিন্তু দেশবাসীর অন্তরে বহিরাগত ছিলেন না। যে সব বিদেশিরা এ দেশে ব্যবসা করছেন, তাঁরা কি চলে যাবেন? হ্যাঁ, যদি কেউ সন্ত্রাস সৃষ্টি করেন এবং সন্ত্রাসে মদত দেন, তাঁর শাস্তি হওয়াই উচিত। তিনি দেশের বা বিদেশের— যেখানেরই নাগরিক হোন না কেন। তবে কোন ব্যক্তি বা সংগঠন সন্ত্রাসবাদী, সেটার নির্বাচন যেন ঠিক হয়।

নিখিল কবিরাজ। হাওড়া

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন