আর্যভট্ট খানের ‘চাঁদের কাছাকাছি’ (রবিবাসরীয়, ২০-৫) পড়ে কিছু স্মৃতিচারণ। গত শতাব্দীর সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়। কেন্দ্রীয় লোক নির্মাণ বিভাগের চাকরি সূত্রে তখন আমি রাঁচীতে। রাঁচীর মেন্টাল হাসপাতালের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমাদের বিভাগের উপর ন্যস্ত থাকায়, যে কোনও ওয়ার্ডেই আমাদের গতিবিধি ছিল অবাধ।
নিবন্ধকার যে সাহেব ক্রিকেটারের কথা উল্লেখ করেছেন, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। ওই সময় তিনি প্রবীণ, সুদর্শন ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। ধীর-স্থির শান্ত স্বভাবের ওই ইউরোপীয় সাহেবের কাছে ছিল একটা অ্যালবাম। এমসিসি (ইংল্যান্ডের ক্রিকেট টিম) টিমের পূর্ণ টেস্ট প্লেয়ারের পোশাকে সজ্জিত গ্রুপ ফটোর এক সদস্যকে নির্দেশ করে বলতেন: এই হচ্ছি আমি। জেনেছিলাম, ইংল্যান্ড ক্রিকেট টিমের তিনি নিয়মিত সদস্য ছিলেন। অন্য এক পারিবারিক ছবি দেখিয়ে বাবা, মা, ভাইবোনের পরিচয় দিতেন। সেখানে তাঁর কিশোর বয়সের ছবি। পরিবার বা সহ-খেলোয়াড়দের সম্বন্ধে জানতে চাইলে নিরুত্তর থাকতেন। মুখে বিষাদের ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠত।
এই সাহেব হাসপাতালের তরফ থেকে কিছু বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পেতেন। তাঁর জন্য ছবি আঁকার সমস্ত সরঞ্জাম-সহ এক স্টুডিয়ো ছিল। প্রায় সারা দিনই ক্যানভাসের উপর অয়েল পেন্টিংয়ে নানা ধরনের ছবি আঁকতেন। তবে কল্পনা করে কিছু আঁকতে পারতেন না, বা দৃশ্য বা বস্তু দেখেও আঁকতেন না। কোনও ছবি দেখেই হুবহু তৈরি হত তাঁর পেন্টিং। নিজের দেশ ইংল্যান্ডের নিসর্গের ছবিই আঁকতে পছন্দ করতেন।
সাহেবের হাসপাতালের গারদের বাইরে যাতায়াতের কোনও বিধিনিষেধ ছিল না। ছবি আঁকতে আঁকতে হঠাৎ বেরিয়ে পড়তেন। গেটের বাইরে গিয়ে কিছু ক্ষণ ঘুরে, নিজের চেম্বারে ফিরতেন। বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুব্জ হয়ে চললেও, তাঁর হাঁটাচলার মধ্যে ছিল একটা দৃঢ়তা ও আভিজাত্যের ছাপ।
মহিলা ওয়ার্ডে মেয়েরা নিজের মনে কাজকর্ম করতেন। কাজ করার কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। কেউ ঘুরে ঘুরে উল বুনতেন। আমাকে দেখতে পেলে শরীরের মাপজোক নিয়ে জানতে চাইতেন কেমন হয়েছে রং ডিজ়াইন, পছন্দ হয়েছে কি না। কেউ কাপড়ে সুতোর নকশা ফুটিয়ে তুলতেন, কেউ সেলাই কাটিং করতেন। গান, আবৃত্তি, নাটক, তাস খেলা— সবই চলত বিশাল খোলামেলা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মহিলা মহলের হলঘরে। কোনও মহিলা কাছে এসে একান্তে বলতেন, ‘‘আমি একেবারে ভাল হয়ে গিয়েছি। কেউ নিতে আসে না, দেখতেও আসে না, আর ভাল লাগে না এখানে। স্বামী-সন্তান সব আছে। কেউ খোঁজ নেয় না।’’ বলে ঝরঝর করে কান্না। ‘‘কলকাতায় আমাদের বাড়িতে গিয়ে বলবেন, আমায় যেন নিয়ে যায়। আপনি তো দেখে গেলেন, আমি ভাল হয়ে গিয়েছি।’’
এক তরুণী অসাধারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। সুদর্শনা মেয়েটি শেষ প্রান্তের জানলার ধারে বসে বাইরের শাল মহুয়া কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়ার ছায়ায় ঢাকা সুরকির পথের দিকে তাকিয়ে অলস প্রহর যাপন করতেন। অনুরোধ করতেই বিষণ্ণ মুখে উদাসী মনে পর পর রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে যেতেন। শুনেছিলাম কোনও এক ব্যর্থপ্রেমের ঘটনাই তাঁকে এখানে নিয়ে এসেছে।
সাধারণ লোকের কাছে এই হাসপাতাল ‘ইউরোপিয়ান পাগলা গারদ’ নামে পরিচিত ছিল। এই হাসপাতালে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক অনুদানের পরিমাণ বেশি থাকার কারণে, পশ্চিমবঙ্গের রোগীরাই ছিল সংখ্যাধিক্য। আশ্চর্য হয়ে ভাবতাম, যে সব মানুষজন এত সুন্দর রং মিলিয়ে ছবি আঁকতে পারেন, নানা দৃষ্টিনন্দন ব্যবহারিক শিল্পকর্ম তৈরি করতে পারেন, তাস-দাবা অতি দক্ষতার সঙ্গে খেলতে পারেন, স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করে একের পর এক নিখুঁত ভাবে গান গেয়ে যেতে পারেন, তাঁদের কেন পাগল বা মনোরোগী বলা হয়!
কৃষ্ণদাস সাহা
কলকাতা-৫২
আইনের শোষণ
সুকান্ত চৌধুরী ‘এক দিকে হিংসার আস্ফালন...’ (৫-৬) নিবন্ধে লিখেছেন, ‘‘আইনের প্রয়োগ যদি উৎকট ভাবে অসম ও পক্ষপাতদুষ্ট হয়,... ক্ষমতাবান বা নিছক উদ্ধত বেপরোয়া যে কেউ প্রকাশ্যে নিরঙ্কুশ ভাবে আইন ভেঙে দাপিয়ে বেড়ায়, তবে সেই বিক্ষিপ্ত প্রয়োগের সময় দণ্ডবিধির যে ধারা-উপধারাই আওড়ানো হোক, বলতেই হয় আইনের শাসন বলবৎ নেই।’’ শাসকের স্বার্থ সুরক্ষিত করতেই যখন একমাত্র আইনের প্রয়োগ হয়, তখন তাকে আইনের শোষণ বলাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
অম্বেডকরকে এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়েছিল: Dr. Ambedkar, do you think democracy will work in India? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘না!’’ কিন্তু কেন? ‘‘কারণ ভারতের সামাজিক কাঠামোটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিপন্থী।’’ ভাবতে অবাক লাগে, সংবিধানপ্রদত্ত আইনের শাসনের অপব্যবহার বন্ধ করতে তিনি আরও কিছু সাংবিধানিক রক্ষাকবচ কেন রেখে গেলেন না। যথার্থ শিক্ষিত গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন সভ্য ভদ্র মানুষের হাতে সংবিধান রক্ষার দায়িত্ব না পড়লে আইনের শাসন কী ভাবে ভূলুণ্ঠিত হতে পারে, হাজার উদাহরণ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র এই রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ের দৈনন্দিন চিত্রেই তা পরিষ্কার। কিন্তু যা বিস্ময়ের, কোনও আলোচনা, বিশ্লেষণে আদালতের ভূমিকাকে আমরা কখনও কার্যকারণ সম্পর্কের একটি অনুঘটক হিসেবে তুলে ধরি না। সামাজিক ভাল-মন্দের কিছুটা দায় কেন পরোক্ষে আদালতের উপর পড়বে না? ভারতের সংবিধান মানুষের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার চূড়ান্ত ও সর্বোচ্চ ক্ষমতা আদালতের হাতেই দিয়েছে। কিন্তু এই রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনে মানুষের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় সদর্থক ব্যবস্থা নিতে আদালত কি তার সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে?
প্রণব রাহা
দুর্গাপুর-৪
ফেক-নিউজ় কী
‘ফেক-নিউজ়’ সংক্রান্ত বিপদ, ক্ষতি ও তা নিয়ন্ত্রণ করতে দণ্ডবিধির কথা লেখা হয়েছে ‘জনস্বার্থে প্রচারিত’ (১২-৬) শীর্ষক সম্পাদকীয়তে। এখন প্রশ্ন হল, ‘ফেক-নিউজ়’ কাকে বলে আর আইনত সংজ্ঞাই বা কী? বাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতায় ভোগ্যপণ্যের গুণমান সাতকাহন করা, নির্বাচনের রণনীতিতে আত্মপক্ষের সততার প্রমাণের চাইতে বিরোধীদের অসততা প্রচারের ঢক্কানিনাদ করা, নিয়তিবাদে অসহায় সমাজনীতিতে জ্যোতিষশাস্ত্র নিজেদের খনা বা বরাহমিহির প্রমাণ করা, অ-উন্নয়নকে গণতন্ত্র বলে চালিয়ে দেওয়া ইত্যাদি কি ফেক-নিউজ় নয়? যে দায়িত্ববোধে এক দিন গণতন্ত্রের চতুর্থ মাধ্যম হয়েছিল, এই সব বিষয় জনিত সংবাদে গণমাধ্যম তা সাধ্যমতো পালন করেছে কি?
শুভ্রাংশু কুমার রায়
ফটকগোড়া, চন্দননগর, হুগলি
যোগাযোগ হয়নি
‘ভোটের মুখে ভারতে বিএনপি নেতারা’ (১৬-৬) শীর্ষক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের পরে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির (বিএনপি) তিন জন নেতা কলকাতায় মার্কিন কনসুলেটে গিয়েছিলেন।
এই তথ্য ঠিক নয়। সংবাদ প্রতিবেদনে যে তিন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে— আবদুল আউয়াল মিন্টু, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং হুমায়ুন কবির— তাঁদের কেউই কলকাতা সফরের সময় মার্কিন কনসুলেট জেনারেল-এ যাননি, তাঁদের কারও সঙ্গে আমাদের কোনও যোগাযোগও হয়নি।
শমীক ঘোষ
মার্কিন কনসুলেট জেনারেল, কলকাতা
প্রতিবেদকের উত্তর: সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা বিদেশ নীতি সংক্রান্ত সংবাদদাতা হিসেবে সূত্রের মাধ্যমে যাচাই করে প্রকাশ করা হয়েছে।