ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) এই মুহূর্তে অন্যতম আলোচনার বিষয়বস্তু বা মাথাব্যথার কারণ হওয়া উচিত সরকারের কাছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) ওয়েবসাইট বলছে, যে কোনও সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে, চিকিৎসা প্রদানকারীকে আগে সুরক্ষিত রাখতে হবে। এ যেন বিমান-যাত্রায় অক্সিজেন মাস্ক ব্যবহার করার ঘোষণার মতো, যেখানে অন্যকে সাহায্য করার আগে নিজেকে সুরক্ষিত হতে হয়।
করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এই চাহিদা খুবই কম: গ্লাভস, মুখোশ আর গাউন। প্রত্যেকটির গুণগত মানের ব্যাপারে হু-র নিজস্ব কিছু মানদণ্ড আছে, যা বজায় রাখা আবশ্যক।
বাজারে মাস্কের অবিশ্বাস্য চাহিদা এবং কালোবাজারি চলছে। এই মুখোশের যৌক্তিকতা কতটা, তা কিন্তু প্রশ্নসাপেক্ষ। এই প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রোটেকশন (সিডিসি) পরিষ্কার জানিয়েছে, মাস্ক শুধুমাত্র এই রোগের চিকিৎসা প্রদানকারী দলের সবার এবং রোগীর জন্য, অন্যদের ক্ষেত্রে এটি অপ্রয়োজনীয়। যাঁরা অসুস্থ নন, বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, কাশি হলে মুখ আড়াল করা ইত্যাদি সাধারণ নিয়মগুলো মেনে চলাই তাঁদের পক্ষে যথেষ্ট।
সারা পৃথিবীতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। তার ফলে সারা বিশ্বে এই ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের চাহিদা বাড়ছে প্রতি দিন। এ সবের মূল প্রস্তুতকারী দেশ চিন, ভারত এবং তাইওয়ান। সিডিসি-র হিসেব অনুযায়ী, চাহিদা বেড়েছে দশ গুণ, আর সেই জন্যই উৎপাদনে তিন-চার মাসের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়েই আমাদের ডাক্তাররা লড়ছেন রেনকোট বা ছেঁড়া গাউন পরে। এ আমাদের দেশের লজ্জা। কিন্ত কেন এমন হল?
ডিসেম্বর মাসে প্রথম উহানে ধরা পড়ে এই ভাইরাস। মার্স, সার্স, ইবোলা— এ তো আর কম হয়নি। তবু আমরা শিক্ষা নিতে পারিনি। ভারতের স্বাস্থ্য সরঞ্জাম উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত দুই অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাদের অভিযোগ, তাঁরা ফেব্রুয়ারি মাসেই কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন, এ সমস্ত সরঞ্জাম যথেষ্ট পরিমাণে মজুত রাখতে। সরকার কর্ণপাত করেনি। স্বাস্থ্য দফতর টেন্ডার করে মার্চের শুরুতে। সমস্যার এখানেই শেষ নয়।
সরকারি পয়সার অপব্যবহার রুখতে কয়েক বছর ধরে চালু হয়েছে জেম (গভর্নমেন্ট ই-মার্কেটিং)। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সুবাদে, বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস জেম-এর মাধ্যমে কিনতে গিয়ে প্রচুর অসুবিধের সম্মুখীন হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। ধরুন, আপনার গবেষণার জন্য একটি বিশেষ যন্ত্র চাই। আপনাকে দেওয়া হবে, আপনার পছন্দের নয়, সব থেকে কম দামের জিনিসটি (পোশাকি নাম এল ১)। গুণগত মানের থেকেও গুরুত্ব পাবে তার মূল্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, এল ১-এ কেনা সরঞ্জামের প্রায় ৮০%-ই ব্যবহার্য নয়। বিশেষত যে গাউন ব্যবহৃত হয় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে, তার মধ্যে দিয়ে কোনও রকম তরল যেতে পারবে না। কিন্ত এল ১-এ প্রাপ্ত অধিকাংশ গাউনই এই রকম নয়। কারণ এ ব্যাপারে সরকারি কোনও মানদণ্ড নেই। নেই কোনও ব্যবস্থা, যা দিয়ে হু-র দেওয়া কষ্টিপাথরে এদের যাচাই করা যায়।
আমাদের দেশে এই মুহূর্তে প্রায় ১২০টি ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী সংস্থা রয়েছে, যাদের প্রতি দিন উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় দেড় লক্ষ। এদের এই মুহূর্তে কাজে লাগাতে হলে সরকারকে প্রথমেই গুণমান নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। সেই সঙ্গে দামও বেঁধে দিতে হবে।
যে লোকাল এন-৯৫ মাস্ক ৩০০-৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, তার বাজারদর ছিল ৯০ টাকা। মনে রাখতে হবে, এদের মধ্যে উঁচু মানের সরঞ্জাম বিদেশে রফতানি করা হয় সারা বিশ্বের চাহিদাকে মাথায় রেখে। আর নিজেদের জন্য পড়ে থাকে নিম্নমানের সামগ্রী। তাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া কিন্ত উৎপাদনের একটা অংশ নিজেদের ব্যবহারের জন্য রেখে দিয়ে, বাকিটুকু রফতানি করে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী, এই মূহূর্তে প্রায় ৫০,০০০ পিপিই প্রয়োজন। বিদেশ থেকে তিনটি কোম্পানির আমদানিকৃত সরঞ্জামের সংখ্যা ২০,০০০। দেশের তিনটি সংস্থা, যারা এগুলো তৈরি করে সেনাবাহিনীর জন্য, তাদের গুণগত মান বস্ত্র মন্ত্রকের প্রযুক্তিবিভাগ পরীক্ষা করছে। মান ঠিক থাকলে এই সংস্থাদেরও বরাত দেওয়া হবে।
হু-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বের ডাক্তারদের বর্তমান অবস্থায় প্রয়োজন কম পক্ষে প্রতি মাসে তিন কোটি গাউন, প্রায় ন’কোটি মাস্ক এবং সাত কোটি গ্লাভস, যা বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতার থেকেও ৪০% বেশি। অথচ করোনার প্রভাবে সব দেশেই উৎপাদন হয় বন্ধ নয় ব্যাহত। তাই আকাল পৃথিবী জুড়ে।
তবে এটাও ঠিক, যে দেশে জিডিপি-র এক শতাংশেরও কম স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ, হাজার হাজার কোটি টাকা মূর্তির জন্য খরচ, যেখানে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ন্যূনতম সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা নেই, ডাক্তারবিহীন কিছু নতুন বিল্ডিং মানে সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল, সেই দেশে আমাদের এই মেধাবী সৈন্যদলের জন্য গুণগত মানের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বোধহয় রাষ্ট্রের কাছে বিলাসিতা। সে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে নিশ্চয়ই।
অরিন্দম চক্রবর্তী
বিশ্বভারতী
নিছক ঠাট্টা?
‘মহিলাদের অনুরোধ করা হচ্ছে বাড়িতে অযথা তাণ্ডব করবেন না। শান্ত থাকুন, পুরুষদের বাড়িতে টিকতে দিন।—জনস্বার্থে প্রচারিত।’ করোনা-কালে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে উথলে ওঠা মেসেজের এটি অন্যতম। পড়ে হাসলাম। হাসা শেষ হলে একটা ছোট্ট প্রশ্ন মাথায় এল: করোনায় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গৃহবন্দি মানুষজনের মধ্যে মহিলারাই কেবল তাণ্ডব করেন? পুরুষ করেন না? কেন করেন না?
পরের পোস্ট আমার কৌতূহল নিরসন করে দিল। আদালতে জজসাহেবের কাছে গিয়ে স্ত্রী বলছেন, ‘আমি বাসন মাজছি, ঘর মুছছি, রান্না করছি। আমার স্বামী সিগারেট টানছেন আর বসে বসে ফেসবুক করছেন। এই বৈষম্য কেন মানব? আপনি বিচার করুন।’ জজসাহেব বললেন, ‘জেনিভা চুক্তি অনুযায়ী বন্দিকে খেতে দিতেই হবে।’ অর্থাৎ স্বামী বাড়িতে থাকা মানে ‘বন্দি’ থাকা। আর স্ত্রীর ক্ষেত্রই হল বাড়ি। এ বারও হাসির পর একটা ছোট্ট প্রশ্ন মাথায় এল: বাড়ি যদি ‘বন্দিশালা’ হয়, সারা বছর স্ত্রী তা হলে কোথায় থাকেন? কারাগারে? হয়তো বা স্নেহের কারাগারে।
মজার ব্যাপার, দুটি মেসেজই আমি দুজন কর্মরতা মহিলার কাছ থেকে পেয়েছি। মেয়েরা আবার চব্বিশ ঘন্টা বিনা পারিশ্রমিকে, বিনা ছুটিতে শ্রম দিলেও ‘কর্মরতা’ হন না। আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন অফিসে কর্মরতা, মাস মাইনে পাওয়া গৃহিণীরা। এইখানেই বিস্ময়। তাঁরা যখন লকডাউনে বাড়িতে আটক হন, তাঁদের ‘বন্দি’ মনে করা হয় না। অথচ তাঁদের স্বামীরা বাড়িতে থাকলে ‘বন্দি’ হয়েই থাকেন।
আরও আশ্চর্যের কথা, সংসারে, সমাজে নিজেদের ভূমিকাকে পরিহাসের বিষয় হতে দেখেও আমরা মেয়েরা নিজেরাই হাসছি। যে মেয়ে ঠিকমতো হাসতে পারবে না, তার রসবোধ নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাবে।
এক সময় মেয়েরা স্কুলে গেলে, চাকরি করলে তাঁদের নিয়ে কবিতা বা গান বেঁধে পরিহাস, খেউড় করার রীতি ছিল। আজ অবস্থা উন্নততর কি না, বোঝা মুশকিল। কিন্তু জটিলতর তো বটেই। এখন যে মহিলা রান্না করেন, চাকরি করেন, এমনকি হয়তো স্বামীকে কর্মক্ষেত্রে ছাপিয়েও যান, তাঁকে নিয়েও একই রকম মশকরা চলে। তিনি নিজেও তাতে অংশ নেন!
এ কথা স্বীকার করতে হবে, এখন অনেক পুরুষই বাড়ির মহিলাদের গৃহকর্মে সাহায্য করেন। কিন্তু সেটি যে সমাজের সার্বিক রূপ নয়, এই ‘নিছক ঠাট্টা’ সহ বহু প্রমাণ সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠা দেয়। নিজের ভাতের থালা মাজা, ঘর মোছা ইত্যাদি অনেক পুরুষই একটু লুকিয়ে করেন। নইলে সমাজের চোখে ‘মেয়েমার্কা’ বা ‘স্ত্রৈণ’ প্রতিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ কথা অধিকাংশ লোকই অবশ্য অস্বীকার করবেন। কিন্তু কেউ ফোন করলে আপনারা পুরুষকে বলতে শুনেছেন, ‘‘ঘরটা ঝাঁট দিচ্ছিলাম তো, তাই ধরতে দেরি হল’’?
সোনালী দত্ত
বেলুড়, হাওড়া
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
ভ্রম সংশোধন
‘স্পেনে অল্প স্বস্তি, আতঙ্কে আমেরিকা’ (পৃ ৬, ৬-২০) শীর্ষক প্রতিবেদনের সঙ্গে করোনা গ্রাফিকে সিঙ্গাপুরে এক দিনে ১২০ জন আক্রান্তের বদলে ১২০ জন মৃত লেখা হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য আমরা দু:খিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।