Barnaparichay

সম্পাদক সমীপেষু: শৈশবের সুখস্মৃতি

বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় দিয়েই জোড়াসাঁকোয় শুরু হয়েছিল শিশু রবীন্দ্রনাথের অক্ষর পরিচয়। হয়তো, বর্ণপরিচয়-এর কাঠিন্য শিশুদের সে ভাবে আকর্ষণ করতে পারে না বলে মনে হয়েছিল তাঁর।

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০২৫ ০৬:০১
Share:

বাঙালির নবপ্রজন্মের শিক্ষার বেহাল দশার সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ হল রিয়া মোদকের ‘অতই সহজ পাঠ?’ (১৬-৪)। আর পাঁচটা বাঙালি ছেলেমেয়ের মতো বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় দিয়েই জোড়াসাঁকোয় শুরু হয়েছিল শিশু রবীন্দ্রনাথের অক্ষর পরিচয়। হয়তো, বর্ণপরিচয়-এর কাঠিন্য শিশুদের সে ভাবে আকর্ষণ করতে পারে না বলে মনে হয়েছিল তাঁর। তাই তাঁর এই প্রয়াস।

রবীন্দ্রনাথ যখন শিশুদের জন্য কিছু লিখতেন তখন তাঁর হৃদয় এবং মন জুড়ে বিরাজ করত এক শিশু। তাই তাদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, কল্পনার রাজ্যে বিচরণ, ভাল লাগা, মন্দ লাগা, অনুভব-অনুভূতি, ইচ্ছে, জিজ্ঞাসা তাঁর লেখায় ধরা দিয়েছে। সহজ পাঠ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী বই। সহজ পাঠ-এর ছন্দ অজানা পৃথিবীর খোঁজ দেয়। বহু দূরের কোনও গাঁ, ফুল কুড়ানোর জীবন। ডাক দিয়ে যায় গাঁয়ের হাট, ছোট নদী, তিল খেত, তিসি খেত, আমবন, তালবন। তার টানেই হয়ে যায় অক্ষর পরিচয়। ছন্দে ছন্দে মিলের আনন্দে খুব দুষ্টু, অমনোযোগী পড়ুয়ার মগজেও ঢুকে যায় সহজ পড়া। আজ এত বছর পরেও বাঙালির মাতৃভাষা শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ হিসাবে বই দু’টির প্রয়োজন আগের মতোই আছে। তাই সহজ পাঠ আজও প্রাসঙ্গিক এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এর কারণ হিসাবে বলা যায়, শিশুরা কবিতা এবং ছবি দুই-ই খুব ভালবাসে। কবিতার ছন্দ ও ছবি তাদের হৃদয়তন্ত্রীতে ঝঙ্কার তোলে, মনে রাখার জন্য খুব সহজ হয় আর নতুন কিছু চিনতে ও কল্পনাশক্তি বাড়িয়ে তুলতে উপযোগী হয়ে ওঠে। বই দু’টির প্রচ্ছদ ও ভিতরের ছবিগুলি বেশ মানানসই। ছবিগুলোর একটা বিশেষত্ব হল, প্রথম ভাগেরগুলো মোটা দাগের ছাপা ছবি। আর দ্বিতীয় ভাগেরগুলো সবটাই রেখাচিত্র। চাইলে শিশুরা ওগুলো বিভিন্ন রঙে রঙিন করতে পারে। রবীন্দ্রনাথের সহজ লেখা ও শেখার ভাবনার সঙ্গে মিল রেখেই ছবি এঁকেছিলেন শান্তিনিকেতনের শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু। হালকা হলুদ, ফিকে হলুদ রঙের উপরে গাঢ় সবুজ কিংবা নীলের প্রচ্ছদেও পাওয়া যায় এই বই।

এই বইয়ের পাতায় আটকে আছে বাঙালির ছোটবেলা। জাতির বহু বিবর্তনের ধারাতেও অম্লান হয়ে আছে এর গৌরব। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিপন্নতার দিনেও মায়ের মুখের ছড়ায়, ছোটবেলার স্মৃতির টানে অক্ষয় আয়ুতে বেঁচে আছে সহজ পাঠ-এর দিন। সোনার অক্ষরে লেখা শিশুপাঠের এই বই হল সকল বাঙালির জন্মদাগ।

গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর

যদি ফিরে পড়ি

‘অতই সহজ পাঠ?’ শীর্ষক প্রবন্ধে রিয়া মোদক লিখেছেন, “গ্রামজীবনকে রোম্যান্টিক দেখানো সত্ত্বেও গ্রামের প্রান্তিক মানুষদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবটা যেন একটু অবজ্ঞার।” তিনি যখন লেখেন, “বিশেষত বামপন্থীরা বলেন, এতে বাংলার সমাজবাস্তবতার প্রকৃত ছবিটি ফুটে ওঠেনি”, মনে হয় যেন, এই ভাবনার সঙ্গে তিনিও সহমত। লেখকের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনও মন্তব্য সমীচীন নয়। আমি শুধু অনুরোধ করব সকলে এই বইয়ের দ্বিতীয় ভাগের কয়েকটা পাঠ থেকে কয়েকটা অংশ যেন আর এক বার নতুন ভাবে পড়ে দেখেন।

আলোচ্য প্রবন্ধেই উল্লিখিত, অত্যাচারী জমিদার দুর্লভবাবু নিচু জাতের মজুর উদ্ধবকে শাস্তি দেয়, মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে সে গ্রামের পুকুর থেকে মাছ ধরার স্পর্ধা করেছে বলে। এও তো সমাজবাস্তবতারই চিত্র। দেখতে হবে, এই অন্যায় ব্যবহারের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তি বা প্রতিবাদের কথা উক্ত বইতে বলা আছে কি না। প্রবন্ধকার বলেছেন, অথচ গ্রামের পুকুরটি নিজে কুক্ষিগত করলেও দুর্লভবাবুর কোনও শাস্তি বা সমালোচনা হয় না। কিন্তু, ঘটনা তো তা নয়।

“বর্তমান ভূস্বামী দুর্লভ-বাবুর পূর্বপুরুষদের আমলে এই পুষ্করিণী সর্বসাধারণের ব্যবহার করতে পেত। এমন-কি, গ্রামের গৃহস্থ বাড়ির কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে প্রয়োজন উপস্থিত হলে মাছ ধরে নেবার বাধা ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি দুর্লভ-বাবু প্রজাদের সেই অধিকার বন্ধ করে দিয়েছেন। অল্প কিছুদিন আগে খাজনা দিয়ে বৃন্দাবন জেলে তার কাছ থেকে এই পুকুরে মাছ ধরবার স্বত্ব পেয়েছে।”— বইয়ের এই মূল লাইনগুলো থেকে যেটা স্পষ্ট, তা হল, পুকুরটা আইনগত ভাবে দুর্লভবাবুরই। বেআইনি ভাবে তিনি কুক্ষিগত করেননি বলেই বৃন্দাবন জেলেকে খাজনার বিনিময়ে ওঁর থেকে মাছ ধরার অনুমতিটি লাভ করতে হয়েছিল। হ্যাঁ, এটা ঠিক, দুর্লভবাবু যে ভাবে উদ্ধবকে শাস্তি প্রদান করতে গিয়েছিলেন, তা নিঃসন্দেহে তাঁর নিষ্ঠুরতারই পরিচায়ক। এ বার দেখা যাক, সেই নিষ্ঠুরতা প্ৰসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কী লিখলেন? দুর্লভবাবুর পিসি কাত্যায়নী দুর্লভকে ডেকে বললেন, “বাবা, নিষ্ঠুর হোয়ো না। উদ্ধবের কন্যার বিবাহে যদি অন্যায় করো, তবে তোমার কন্যার অন্নপ্রাশনে অকল্যাণ হবে। উদ্ধবকে মুক্তি দাও।” অন্যায়কারীর মরমে আঘাত করার পক্ষে এই কথাগুলি কি যথেষ্ট নয়? অন্তত ছোটদের সামনে?

আর একটি উদাহরণ। “বোষ্টমী গান গাইতে এসেছে। ওকে নিষ্ঠুর হয়ে বাইরে রেখো না। বৃষ্টিতে ভিজে যাবে, কষ্ট পাবে।” যে শক্তিবাবুর কথা প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে, সেই শক্তিবাবুরই এক দারোয়ানের নাম ছিল আক্রম মিশ্র। শিকার থেকে ফেরার পথে শক্তিবাবুর অনুরোধে কাঠুরিয়ারা যখন এই অপরিচিতদের তাঁদের ঘরে নিয়ে গেলেন, তাঁরা “শক্তিবাবুকে আক্রমকে যত্ন করে খেতে দিলে।” এমনকি, তাঁদের উপকার স্বীকার করতেও একটুও দ্বিধা বোধ করলেন না এই শক্তিবাবু। দশ টাকার নোট বার করে তিনি বললেন, “বড়ো উপকার করেছ, বকশিশ লও।”

বর্ণিত হয়েছে এক বিশ্বম্ভর ডাক্তারের কথা, যিনি কিনা সাত ক্রোশ দূরে ডাকাতের উপদ্রব আছে জেনেও রোগী দেখতে যেতে চাইছেন এই বলে, “বাবা, রোগী কষ্ট পাচ্ছে, আমাকে যেতেই হবে।” শুধু তা-ই নয়, তাঁদের দলের লাঠির ঘায়ে আহত তিন ডাকাতকে পর্যন্ত সেবা করতে কুণ্ঠা বোধ করছেন না এই ডাক্তারবাবু। তাঁকে বলতে শোনা যাচ্ছে, “ঐ তিনটে লোকের ডাক্তারী করা চাই। ব্যান্ডেজ বাঁধতে হবে।”

উপরের উদাহরণগুলোতে কি প্রান্তিক মানুষদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অবজ্ঞার ভাব প্রকাশিত হল? মনে তো হয় না। সহজ পাঠ এমন একটা বই যেখানে সরাসরি উপদেশ দেওয়া নেই। সেখানে পাঠগুলির উপস্থাপনের গুণেই শিশু শিখে ফেলে প্রয়োজনীয় অনেক কিছু। তারা পরিচিত হতে শেখে প্রকৃতির সঙ্গে, চার পাশের মানুষজনের সঙ্গে, সর্বোপরি সামাজিক ন্যায়-অন্যায়ের সঙ্গে। শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে এই রকম বই সত্যিই তুলনাহীন।

গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪

বাস্তবের জলছবি

রিয়া মোদকের ‘অতই সহজ পাঠ?’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের বন্যায় প্লাবিত ধানখেতের মধ্য দিয়ে পদ্মা বোটে বহু বার যাতায়াত করতেন আর পদ্মা, ভৈরব, গড়াই প্রভৃতি নদীর তীরে বোট বেঁধে গ্রামের বাস্তব অবস্থা স্বচক্ষে দেখতেন। তাই তাঁর সহজ পাঠ-এ শুধুই রোম্যান্টিকতা নয়, বাস্তব দৃশ্যপটও আছে। এর প্রমাণ মিলবে তাঁর পত্রের মধ্যে, তাঁর উচ্চারিত শব্দমাধুর্যে। গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা, ধান কাটার চিত্র, ভরা নদী ক্ষুরধারা-র নিসর্গ বর্ণনায় নিখুঁত বাস্তবচিত্র ধরা পড়েছে। চাষিরা ঢাক বাজায় খালে বিলে, আচার অনুষ্ঠানে উলু দেওয়া, বর্ষায় গ্রামীণ মানুষদের জীবনযাত্রার কষ্টকর ছবি— সবটাই বড় বাস্তব। ‘আমাদের ছোট নদী চলে’ নিখাদ বাস্তব।

মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ কোনও দিনও জাতিভেদ, বর্ণবৈষম্য এবং লিঙ্গভেদের মতো অমানবিক প্রথা মানতেন না। পাবনা জেলার সাজাদপুরে জমিদারির তদারকিতে গিয়ে দেখেন নমশূদ্রদের সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। কবি ধর্মের নামে জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন। ‘ধর্মের অধিকার’ প্রবন্ধে ওই অমানবিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

মনোরঞ্জন মৈত্র, বারাসত, উত্তর ২৪ পরগনা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন