উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সস্তা হাততালির রাজনীতি’ (৫-১) ও প্রদীপ নারায়ণ ধরের ‘ভন্ডামি’ (সম্পাদক সমীপেষু, ৩-১) শীর্ষক পত্রে সাভারকরের প্রসঙ্গ ওঠায় দু’চার কথা বলার তাগিদ অনুভব করলাম। গো-তাণ্ডব, দলিত দলন-সহ তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীদের যাবতীয় অবিবেচক ও অনৈতিক কর্ম নিয়ে সংবৎসর সংবাদপত্রের রোষানলে বীর বিনায়ক দামোদর সাভারকর কেন দাহ হবেন, তা মর্মন্তুদ বিষয়।
উদয়নবাবুর লেখা ধরেই এগোই। আজকের হিন্দুত্ববাদী ভারত সাভারকরকে এক বিন্দু গ্রহণ করেনি। সাভারকর হিন্দুধর্মের সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়টিতে অভিমন্যুর মতো ঢুকে পড়েছেন। ভারতের কী নিয়ে ভাবা উচিত? গো-সুরক্ষা না কি গো-পূজা? সাভারকর স্পষ্ট বলেছেন, ‘‘গরু ঈশ্বরও নন, মাতাও নন, নিখাদ এক উপকারী প্রাণী। আমাদের গোপূজায় ধ্যান না দিয়ে, গরুর বংশবৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যকর প্রতিপালনে মন দেওয়া উচিত। গো-সম্পদ সৃষ্টি ও তার সর্বোত্তম ব্যবহার জাতির সমৃদ্ধির অন্যতম হাতিয়ার। এই পুরো প্রক্রিয়াকে সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে, গরুকে নিয়ে আম হিন্দু মনে বৈপ্লবিক উত্তরণ দরকার। ধর্মীয় দুর্বলতা ও সংস্কারকে ভুলে চাই বাস্তব ও বৈজ্ঞানিক ভাবনার উদয়।’’
যে ভাবে যুক্তিতে ব্রাহ্মণ্যবাদকে শুইয়ে দিয়ে রত্নগিরির প্রাচীন বিট্টল মন্দিরে তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে প্রবেশাধিকারের লড়াই জিতেছেন, আজ সাভারকর বেঁচে থাকলে শবরীমালায় একই কাণ্ড করে ছাড়তেন। তাঁর অনন্ত উদ্যোগ ও শেঠ ভাগোজি বীরের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৩১ সালে উচ্চ-নীচ বর্ণ নির্বিশেষে সব হিন্দুদের প্রবেশের জন্য স্থাপিত পতিতপাবন মন্দির গাঁধীজিকে এতটাই আলোকিত করে, তিনি কস্তুরবাকে সঙ্গে নিয়ে সাভারকরের সাক্ষাতে আসেন। গতানুগতিক রীতিতে অস্পৃশ্যদের হস্তে শঙ্করাচার্যকে সরাসরি অভিবাদন করার রেওয়াজ না থাকলেও, চামার জাতের নেতা রাজভোজ শঙ্করাচার্যকে পাদ্যার্ঘ্য দেন। সাভারকর কুসংস্কারের কোটর থেকে হিন্দু সমাজকে টেনে বার করে আনতে চেয়েছেন। নিজে চিৎপাবন ব্রাহ্মণ হয়ে অব্রাহ্মণ ও অন্ত্যজ মানুষদের বলেছেন, ‘‘ধর্মীয় ও মাঙ্গলিক কাজে ভাটদের (ব্রাহ্মণদের) আহ্বান করার রীতি থেকে সরে এলে ভাটশাহী অস্তিত্ব তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে।’’ কেন আমরা ভুলে যাই সাভারকর ছিলেন ‘ফাদার অব হিন্দু র্যাশনালিজ়ম’, তিনি কোনও দিন ‘ফাদার অব হিন্দুইজ়ম’ নন।
সাভারকর মানেই হিন্দুত্ববাদী, সাম্প্রদায়িক, ব্রিটিশের ক্ষমাপ্রার্থী নন। কেউ তো এক বারও বলেন না, ২৭ বছর ৪১ দিন বয়সে এম এস মোরিয়া জাহাজ থেকে তাঁর মহাকাব্যিক ঝাঁপানোর সেই গপ্পো। এক দিকে ডুবসাঁতার অন্য দিকে ব্রিটিশ পুলিশের গুলিবৃষ্টি। কেন ২৪ বছর ১১ দিন বয়সে লেখা ‘ওয়ার অব ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স’ বইটি প্রকাশের আগেই ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে?
ব্রিটিশের কাছে ‘মার্সি পিটিশন’ বা ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ যে নিছক বাহানা, সেটা ব্রিটিশ বুঝেছিল বলেই মুক্তি দেয়নি। দেশীয় সমালোচকরা বুঝতে চাইলেন না কোনও দিন। আইরিশ বিপ্লবীদের হাতিয়ার করে মুক্তি মার্সেই অভিযান আর এমডেন অভিযান, ত্রিমাত্রিক চেষ্টা চুরমার হয়ে যাওয়ার পর ‘মার্সি পিটিশন’-এর অছিলায় মুক্তির চেষ্টা হয়। আদালত চত্বরে সাভারকরকে নিয়ে আসা কিংবা ফেরত নিয়ে যাওয়ার সময় আইরিশ বিপ্লবীরা পুলিশ ভ্যান আক্রমণ করে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে, এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হল। মার্সেই বন্দরে এম এস মোরিয়া জাহাজ নোঙর করলেই সাভারকরের সহযোদ্ধারা তাঁকে ছিনিয়ে নেওয়ার চরম কৌশল কাজে লাগাবেন। সময়ের হেরফেরে দেরিতে পৌঁছলেন বারাহানেরি বেঙ্কটেসা সুব্রমণিয়া আইয়ার ও মাদাম কামা। সরোজিনী নাইডুর ভাই বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের অফুরান উদ্যোগ ও লালা হরদয়াল, রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ, ড. চম্পারণ পিল্লাইদের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় গঠিত ‘বার্লিন কমিটি’র পরিকল্পনা ছিল, ৫০০ জন জার্মান অফিসার ও ১,০০০ সেনা সংবলিত জার্মান জাহাজ এমডেন ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজের ওপর আঘাত হানবে। আন্দামানের জেল থেকে সাভারকর-সহ রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্ত করবে। দুর্ভাগ্য, আগাম খবর পাওয়ায় ব্রিটিশরা এমডেন ধ্বংস করল।
প্রদীপবাবুর পত্র প্রসঙ্গে বলি, চলমান ভারত এক শতাংশ সাভারকর-উত্তরসূরি নয়। ১৯৪৪ সালের ২৫ জুন আজ়াদ হিন্দ রেডিয়ো থেকে সুভাষ বলেন, ‘‘যখন কংগ্রেস দলের প্রায় সব নেতার বিপথগামী রাজনৈতিক চিন্তন ও দিশাহীনতায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেনারা ভাড়াটে সেনার মতো দিন যাপনের যন্ত্রণায় রোদনে ব্যস্ত, ঠিক সে সময় অকুতোভয় সাভারকরের ভারতীয় যুবাদের সশস্ত্র বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির পরামর্শ যেন প্রাণের সঞ্চার। এই যুবাদের অন্তর্ভুক্তি আজ়াদ বাহিনীতে সেনা ও সেবক সরবরাহে সহায়ক হবে।’’ ১৯৪০ সালের ২২ জুন, সাভারকরের দাদারের বাড়িতে সুভাষ-সাভারকর বৈঠক, সাভারকর সুভাষকে জার্মানি ও জাপানে পৌঁছবার পরামর্শ দেন। রাসবিহারী বসুর সঙ্গে সাভারকরের নিয়মিত যোগাযোগের কথা সুভাষকে জানান। ফলে, সাভারকর সুভাষের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছেন এটি স্বর্ণ অশ্বডিম্ব।
আক্রোশের মেঘ দিয়ে যুক্তির সূর্যকে ঢেকে রাখার চেষ্টা তো অনেক হল, এ বার একটু প্রায়শ্চিত্ত হোক।
সুদীপ দাস
কলকাতা-৮৪
জানতে হবে
আমার ‘নেতাজি ও সঙ্ঘ’ (১১-১২) চিঠির উত্তরে ‘ভণ্ডামি’ চিঠির জবাব এটি। লেখক লিখেছেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে আরএসএসের পরিচালক গোলওয়ালকরের মন্তব্য ছিল, ব্রিটিশ বিরোধিতাকে ভাবা হচ্ছে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ এবং স্বাধীনতা আন্দোলনকে নাকি আরএসএস প্রতিক্রিয়াশীল ভেবে কোনও কর্মসূচিতে অংশ নেয়নি।
জেনে রাখা দরকার, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতা ডা. কেশব বলিলাম হেডগেওয়ার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। হেডগেওয়ার প্রতিষ্ঠিত সঙ্ঘের উপর ইংরেজ গুপ্তচরদের নজর পড়ে ১৯২৭ সালেই। গুপ্তচর বিভাগের রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯৩২-এর ১৫ ডিসেম্বর মধ্য ভারতে ইংরেজ আমলে সরকারি কর্মচারীদের আরএসএসে যোগদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সার্কুলার জারি হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে হেডগেওয়ার জনমত তৈরি করেছিলেন। ১৯৩০ সালে জঙ্গল সত্যাগ্রহ বা জঙ্গল আইন অমান্য করার অপরাধে হেডগেওয়ারের ১১ মাসের কারাদণ্ড হয়। কলকাতায় ডাক্তারি পড়ার সময় হেডগেওয়ার ‘অনুশীলন সমিতি’র সঙ্গে যুক্ত থেকে ‘কোকেন’ ছদ্মনামে বিপ্লবীদের কাছে পরিচিত ছিলেন।
এও বুঝতে হবে, কেন সাভারকর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে হিন্দু যুবকদের যোগ দিতে বলেছিলেন। সেই সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মাত্র ৩৩% হিন্দু সৈন্য ছিল। বিদেশি ইংরেজ হিন্দুদের বিশ্বাস করত না; কিন্তু যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ায় বিপদে পড়ে ইংরেজ সরকার সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়েছিল। সাভারকর এই সুযোগ নিয়ে হিন্দু যুবকদের দলে দলে বাহিনীতে যোগদানের আহ্বান জানান। সেই সময়ে ৭২% হিন্দু সৈন্য না থাকলে দেশভাগের পর কাশ্মীর আক্রান্ত হলে অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে এ দেশ রক্ষা সম্ভব ছিল না।
লেখকের শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে অভিযোগের উত্তরে বলি, তিনি কোনও দিনই ইংরেজদের পক্ষে ছিলেন না। ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকারীদের উপর ব্রিটিশ শাসকদের অমানবিক অত্যাচারের বলিষ্ঠ প্রতিবাদ একমাত্র শ্যামাপ্রসাদই করেছিলেন। অগস্ট আন্দোলনে মেদিনীপুর এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাংলার গভর্নরের দমননীতি ও দেশবাসীর উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে তিনি ফজলুল হক মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। অতএব, কে ভন্ড আর কে দেশপ্রেমিক, ইতিহাসের পাতায় উল্লেখ রয়েছে।
তরুণ কুমার পণ্ডিত
কাঞ্চন তার, মালদহ
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
ভ্রম সংশোধন
• ‘এ বারেও পদকহীন বঙ্গের আইপিএস’ শীর্ষক সংবাদ প্রতিবেদনে (রাজ্য, পৃ ১০, ২৬-১) রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক প্রাপক হিসেবে লালবাজারের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার অলোক কুমার সান্যালকে এএসআই লেখা হয়েছে।
• ‘বাংলার ক্রীড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্য অনুদান রাজ্য সরকারের’, শীর্ষক সংবাদ প্রতিবেদনে (খেলা, পৃ ১৭, ২৯-১) ব্যবহৃত ছবির ক্যাপশনে আখতার আলির বদলে লেখা হয়েছে সুকুমার সমাজপতির নাম।
অনিচ্ছাকৃত এই ভুলগুলির জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।