Anne Frank

সম্পাদক সমীপেষু: আত্মবলি আনে ফ্রাঙ্ক

আজ এত বছর পরেও আনে ফ্রাঙ্কের ডায়েরি সারা বিশ্বে বহুল পঠিত একটি বই। হবে না-ই বা কেন! অত যন্ত্রণার মধ্যে থেকেও আনে আস্থা হারায়নি, তার শক্তি তো চিরকালীন মানবতার।

শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৫ ০৫:৫৩
Share:

নীলাঞ্জন হাজরা ‘শুনেছ কি মানুষের কান্না’ (২৮-৬) প্রবন্ধে বিশিষ্ট উর্দু কবি ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়-এর লেখা হিংসা ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে মানবতার সত্য তুলে ধরা বিভিন্ন কবিতা নিয়ে মননশীল আলোচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল আনে ফ্রাঙ্কের ডায়েরির কথা। সেই অমৃত-কিশোরী ডায়েরির পাতায় লিখেছিল, যেখানে আশা আছে, সেখানেই জীবন আছে। এই আশা আমাদের নতুন সাহস জোগায় এবং শক্ত হতে সাহায্য করে। লিখেছিল— আমি লিখতে শুরু করলেই সব ঝেড়ে ফেলতে পারি, আমার দুঃখ দূর হয়ে যায়, আমার সাহস ফিরে আসে। ছোট্ট মেয়েটা এমনই সব আশাবাদের কথা জন্মদিনে উপহার পাওয়া ডায়েরিতে লিখত। ১৯৪২ সালের জুন থেকে ১৯৪৪ সালের অগস্ট সময়কালের মধ্যে এই কথাগুলো লিখেছিল তখন পুরোদমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। নাৎসি জার্মানি যখন অ্যামস্টারড্যাম দখল করল তখন ফ্রাঙ্ক পরিবার একটা ভাঙা বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে লুকিয়ে পড়ে। ওই ছোট্ট জায়গায় ছিল আনে-সহ মোট আট জন। দুই বছর ওই জায়গাতেই থাকা, সামান্য কিছু খাওয়া, শোয়া-ঘুম, শৌচালয়ের কাজ— সবই সারতে হয়। এ দিকে বাইরে সারা শহরে নাৎসিদের মৃত্যুবাহিনী ঘুরে বেড়াচ্ছে। উপরে আকাশ থেকে মুহুর্মুহু বোমা পড়ছে। ধরা পড়লেই সব শেষ। এরই মধ্যে সে ডায়েরি লিখে গিয়েছে। লিখেছে তার কথা। তার বাবা মায়ের কথা। লিখেছে তার শরীর কী ভাবে বদলে যাচ্ছে, সে সব বর্ণনাও। সে অকপটে লিখে গিয়েছে তার মনের ভাবনার কথা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। নাৎসিদের হাতে তারা সকলেই ধরা পড়ে। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে টাইফাস জ্বরে আনে মারা যায়। শুধু আনের বাবা ওটো ফ্রাঙ্ক বেঁচে ফিরেছিলেন। যুদ্ধ শেষে নাকি তাঁর হাতে আসে আনের সেই ডায়েরিটি।

আজ এত বছর পরেও আনে ফ্রাঙ্কের ডায়েরি সারা বিশ্বে বহুল পঠিত একটি বই। হবে না-ই বা কেন! অত যন্ত্রণার মধ্যে থেকেও আনে আস্থা হারায়নি, তার শক্তি তো চিরকালীন মানবতার। ডায়েরির পাতায় পাতায় আনে ফ্রাঙ্ক নামের সে দিনের সেই কিশোরী মেয়েটির মরমি উপলব্ধির কথাগুলো— সব কিছুর পরেও আমি বিশ্বাস করি মানুষ হৃদয়ে সত্যিই ভাল— হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে আজও তা জরুরি পাঠ্য। এখনও বিস্ময় লাগে আনে ফ্রাঙ্কের ডায়েরি পড়লে। আর মনে প্রশ্ন জাগে, সে দিন ছোট্ট মেয়েটা যা ভাবতে পেরেছিল, মানবসভ্যতার উন্মেষের এতগুলো বছর পরেও এত মৃত্যু দেখার পরও আমরা বড়রা জীবনের সেই সহজ সত্যগুলো বুঝতে পারি না কেন?

কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া

থাকে দুধে-ভাতে

‘শুনেছ কি মানুষের কান্না’ শীর্ষক প্ৰবন্ধে নীলাঞ্জন হাজরা একটি বাক্যে খুব সুন্দর ভাবে একটা অলঙ্কার ব্যবহার করেছেন, যার পোশাকি নাম ‘অক্সিমোরন’ বা ‘বিরোধালঙ্কার’, অর্থাৎ, একটি বাক্যে পরস্পর স্ব-বিরোধী দুটো শব্দের একত্রীকরণ। বস্তুত, সেই বাক্যটিই এই প্রবন্ধের সারাৎসার। ‘যুদ্ধ মানবসভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’— এই বাক্যটাতে একই সঙ্গে রয়েছে ‘যুদ্ধ’ ও তারই বিপরীতধর্মী একটি শব্দ ‘সভ্যতা’। অর্থাৎ, যুদ্ধ মানব-সভ্যতার প্রতিবন্ধক হলেও মানুষের ক্রমবর্ধমান হিংসা ও লোভের প্রভাবে আজও তা সমাজের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে রয়ে গিয়েছে। প্ৰবন্ধকার তাঁর রচনার প্রায় শেষে প্রখ্যাত উর্দু কবি ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়ের ‘সিপাহি কা মর্সিয়া’ নামক কবিতাটির পটভূমির বর্ণনা করতে গিয়ে যা বলেছেন, তা সেই অবিচ্ছেদ্যতার কথাই স্মরণ করায়।

উক্ত কবিতাটির প্রেক্ষাপট, ১৯৬৫ সাল। ষাট বছর বাদে, সাম্প্রতিক অতীতে যখন পাক-ভারত সংঘাতের আবহ তৈরি হল, কী আশ্চর্য! এই যুদ্ধোন্মত্ততা কমার তো কোনও লক্ষণই দেখা গেল না, বরং তা আরও হিংস্র রূপ নিয়ে দেশের উচ্চতম সেনা-নেতৃত্বকেও নিশানা করতে ছাড়ল না। রবীন্দ্রনাথের সেই অমোঘ উচ্চারণ মনে করিয়ে দিল, ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব’— আজকের দিনেও কী ভীষণ তার প্রাসঙ্গিকতা।

আজ সময় যত এগোচ্ছে, ততই যেন ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সভ্যতার সঙ্কট বেশি করে ঘনীভূত হচ্ছে। এখন তো প্রায় সারা পৃথিবী জুড়েই দেখা যাচ্ছে আধিপত্যবাদের নগ্ন চেহারা। এক দিকে পশ্চিম এশিয়ায় ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাতের প্রভাবে গাজ়া প্রায় কবরস্থানে পরিণত, অন্য দিকে পূর্ব ইউরোপে ইউক্রেনের মতো একটা সুন্দর দেশও যুদ্ধবাজ রাশিয়ার দাপটে জরাজীর্ণ। লেবানন, সিরিয়া, মায়ানমারে কাতারে কাতারে শরণার্থীদের স্রোত তো রয়েছেই। এদের সঙ্গে আবার সদ্য যুক্ত হয়েছে আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদতে ইজ়রায়েলের সঙ্গে ইরানের সংঘর্ষ সেখানেও প্রাণহানি বা সম্পদ নষ্ট হওয়ার মতো ঘটনা বেশ উল্লেখযোগ্য। কোথাও মানুষ শান্তিতে নেই। প্রায় প্রতি দিনই পৃথিবীর কোনও না কোনও প্রান্তের মানুষজন যেন শুনতে পাচ্ছেন রবিঠাকুরের কবিতার সেই পঙ্‌ক্তিগুলো— “যুদ্ধের দামামা উঠল বেজে/ ওদের ঘাড় হল বাঁকা, চোখ হল রাঙা,/ কিড়মিড় করতে লাগল দাঁত।/ মানুষের কাঁচা মাংসে যমের ভোজ ভর্তি করতে/ বেরোল দলে দলে।”

দেশের হয়ে লড়াই করা বা প্রাণ দেওয়া নিশ্চয়ই গৌরবের। এতে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু, তার সঙ্গে এটাও ভাবার প্ৰয়োজন, যা ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়-এর কবিতার সূত্র ধরে লেখক এই প্রবন্ধটি জুড়েই আলোচনা করেছেন, সেই যুবকটির কথাও, ক্ষমতালিপ্সু দেশের পক্ষে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে যাকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে, যে আর কোনও দিনও জেগে উঠবে না এবং যার মা-বাবা-স্ত্রী-ভাইয়ের হৃদয়ের অলীক আশা ও অবুঝ প্রতীক্ষা রাতকে অনন্ত করে তুলবে। প্রতিহিংসার নেশায় বুঁদ হয়ে বাইরে থেকে শুধু লাভ-লোকসানের অঙ্ক নিয়ে ভাবলে হবে না, নিজেদের মুখোমুখিও হতে হবে। স্বজন হারানোর যে ব্যথা, তার তীব্রতাটা অনুভব করতে হবে। এবং সেটা করতে পারলেই এই সর্বনাশী যুদ্ধের উপর আমাদের সাধারণ মানুষের বিতৃষ্ণা জাগবে, তাকে নিয়ে আমাদের হিংস্র উন্মাদনাটাও কমবে।

এ প্রসঙ্গে খুবই উল্লেখযোগ্য একই দিনে প্রকাশিত ‘যুদ্ধ বন্ধে রাস্তায় ইজ়রায়েলি মায়েরা’ (২৮-৬) শিরোনামে একটি খবর, যেখানে জানা যাচ্ছে, সরকার-বিরোধী সেই মিছিলের অধিকাংশই ছিলেন মধ্যবয়সি মহিলা, যাঁদের ছেলেরা গাজ়া ভূখণ্ডে যুদ্ধে গিয়েছেন। মৃত্যুর পরে কুচকাওয়াজ, গান স্যালুট, বিউগল-ধ্বনি মা-বাবা এবং নিকটজনদের বুক গর্বে ভরিয়ে তুলবে, তা যেমন ঠিক, তেমনই এগুলো শেষ হয়ে গেলে সেই বুকগুলোই আবার হাহাকার করে উঠবে, যন্ত্রণায় বিদীর্ণ হবে। এই মায়েরা এটাই চান যে, সরকার যেন যুদ্ধকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে, যাতে তাঁদের সন্তানেরা যত বেশি সম্ভব এই পৃথিবীর আলো দেখতে পান এবং জীবনটা উপভোগ করার সুযোগ পান।

গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪

মর্মস্পর্শী

পীযূষ রায়চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘তালিবানের দেশে, মার্কো পোলোর পথে’ (২৯-৬) পড়ে মুগ্ধ হলাম, ঋদ্ধ হলাম। বিপদসঙ্কুল এই যাত্রা অবশ্যই অনন্যতার দাবি রাখে। সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে-তে দেখেছি আফগানিস্তানকে আধুনিক করে তোলার প্রচেষ্টা, যদিও প্রবল গৃহযুদ্ধ তা সফল হতে দেয়নি। এর পর অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে তালিবানের কব্জাকৃত আফগানিস্তান, যার ভাবনা বেদনা দিয়েছে কেবল।

লেখককে ধন্যবাদ অত্যন্ত সহমর্মিতার সঙ্গে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরার জন্য। ইতিহাস, ভূগোল এবং অবশ্যই মানবিকতায় মোড়া স্বাদু রচনা। ওয়াখি, কিরগিজ় জনজাতি গোষ্ঠী সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা গেল। এই একবিংশ শতকেও সেখানকার মেয়েদের অসহায়তায় নিজেও যেন অসহায় বোধ করছি। ভুলতে পারছি না মুসায়েরের সেই কথা— “উইমেন আর অলওয়েজ় ইজ়ি প্রে।”

শামিমা রশীদ, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন