অনির্বাণ চক্রবর্তীর ‘কে বলেছে?’ (১৩-৬) চিঠি পড়ে বিস্মিত হলাম। বিভাস চক্রবর্তীর (ছবিতে)মতো এক জন বিশিষ্ট সর্বজনশ্রদ্ধেয় নাট্যব্যক্তিত্বকে এ ভাবে বলা যায়! নাটকে নাকি লোকশিক্ষে হয়। এই শিক্ষে? বিভাস চক্রবর্তী তাঁর লেখায় (‘আরো কত ছোটো হব ঈশ্বর’, ২-৬) তো কোথাও মফস্সলের নাট্যদল আর কলকাতার নাট্যদলের তুলনা বা বিরোধের কথা বলেননি। তিনি তাঁর লেখায় দেখাতে চেয়েছেন, শঙ্খ ঘোষের মতো এক জন কবি নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে সেই সুদূর অতীত থেকে কী ভাবে তাঁর নিরপেক্ষ মানবিক অবস্থান বজায় রেখেছেন। শুধু তা-ই নয়, বিভাসবাবু তাঁর লেখায় শাসক ও বিদ্বজ্জনের মধ্যে যে কোথাও একটা অসামঞ্জস্য থাকে, একটা মানিয়ে না নিতে পারার যন্ত্রণা থাকে, তারও উল্লেখ করেছেন নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যে। বিভাসবাবুর লেখার মূল বিষয়ে না গিয়ে একটা খুব সাধারণ লাইন তুলে নিয়ে পত্রলেখক এ কী করলেন!
বিভাস চক্রবর্তীর অজস্র স্মৃতিধার্য নাটকের কথা আমরা জানি। বাংলা নাট্যে বিভাসবাবুর অবদানের কথাও কারও অজানা নয়। পত্রলেখক বলছেন, তাঁর দল নাকি সারা দেশে নাটক করে বেড়ায়, ভীষণ জোরালো নাকি সে সব নাটক, অনেক শো তাঁকে নাকি ছেড়েও দিতে হয়, এত চাপ! এ সব কথা বলার আগে নিজের ও নিজের দলের প্রকৃত পরিচিতির গণ্ডি সম্পর্কে, নিজের ওজন সম্পর্কে ধারণা করতে হত।
সব চেয়ে বড় কথা, কী ভাবে এক জন অগ্রজ বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্বের কথায় অমত প্রকাশ করতে হয়, সেটা তো জানা দরকার আগে। বিভাসবাবুর লেখাটা ভাল করে পড়লেও কিন্তু সেটা অনেকখানি শিখে নেওয়া যায়।
রেইনি চৌধুরী সিউড়ি, বীরভূম
কোন অধিকারে
শ্রদ্ধেয় প্রবাদপ্রতিম নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তীর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় (‘আরো কত ছোটো হব ঈশ্বর’, ২-৬) শঙ্খ ঘোষের কাব্যধারার একটি দিক নিয়ে। লেখাটির মূল অভিমুখ ছিল: নানা সামাজিক অনিয়মের বিরুদ্ধে শঙ্খ ঘোষের কলমের নিরপেক্ষ সচলতা। সেখানে কথাপ্রসঙ্গে বিভাস লিখেছিলেন, ‘‘তাঁর (শঙ্খ ঘোষের) একটি প্রশংসাসূচক মন্তব্য বা বাক্য থিয়েটারের বিজ্ঞাপনে প্রকাশ করতে পারলে ধন্য বোধ করেছে নাট্যদলগুলি।’’
লক্ষণীয়, ‘নাট্যদলগুলি’ অর্থে কিন্তু এখানে যে সমস্ত নাট্যদল তাদের বিজ্ঞাপনে শঙ্খ ঘোষের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে, তাদের কথাই বলা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সকল নাট্যদলের কথা এখানে মোটেও বলতে চাওয়া হয়নি। আক্ষরিক ও ভাবগত— যে ভাবেই বিশ্লেষণ করুন, ওই পঙ্ক্তির এই অর্থই আসবে। অথচ অনির্বাণ চক্রবর্তী এই পঙ্ক্তির সূত্র ধরে কিছুটা অযৌক্তিক ভাবে বিভাসবাবুকে এক প্রকার আক্রমণই করেছেন সৌজন্য ও সংস্কৃতির তোয়াক্কা না করেই।
অথচ এই লেখায় বিভাসবাবু ‘শাসক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব’-এর যাপন নিয়ে যা বলেছেন, তা নিয়ে একটি কথাও অনির্বাণ বলেননি, বলেননি শঙ্খ ঘোষের কবিতাগুলি নিয়ে বিভাস চক্রবর্তীর অনুভবী উচ্চারণগুলির কথা। অনির্বাণ তাঁর চিঠির প্রথমেই বলেছেন, ‘‘...শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে কোনও বিতর্কে যেতে চাই না, কারণ উনি বড় মাপের মানুষ।’’ তা হলে বিভাস চক্রবর্তী বড় মাপের মানুষ নন? বাংলা নাট্যজগৎ ও তার প্রাথমিক ইতিহাস না জানা থাকলে অবশ্য এ ধরনের কথাবার্তাই আশা করা যায়।
আবার দেখুন, অনির্বাণ শঙ্খ ঘোষকে বড় মাপের মানুষ বলছেন, বলছেন তাঁকে নিয়ে বিতর্কে যেতে চান না, আবার পর ক্ষণেই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছেন পরোক্ষে— তিনি (শঙ্খ ঘোষ) নাকি দলগত মুন্সিয়ানাহীন, দুর্বল, প্রচারসর্বস্ব, দিল্লির আর্থিক সহায়তার মুখাপেক্ষী নাটককে প্রশংসাসূচক সমালোচনা লিখে দেন! আবার দর্শকদের সম্পর্কেও কী অবজ্ঞা, দর্শকরা শুধু বিজ্ঞাপন ও শঙ্খ ঘোষের প্রশংসা শুনেই নাকি নাটক দেখতে ছুটে যান। গোটা চিঠিতে এ রকমই সব কথা!
আশ্চর্য হলাম, কলকাতার নাট্যদল আর মফস্সলের নাট্যদল— এ রকম দু’টি বিভাগও পত্রলেখক তৈরি করে ফেলেছেন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে। কলকাতায় যেমন অনেক ভাল নাটক হয়, মফস্সলেও অনেক ভাল নাটক হয়। আবার উল্টোটাও দেখা যায়। খারাপ বা দুর্বল নাটক কলকাতা বা মফস্সল দু’টি জায়গাতেই হয়।
আর দর্শকেরও তো গুণগত মানের প্রভেদ আছে। চিরকালই রসিক, পণ্ডিতদের কদর সংস্কৃতিজগতে আছে, থাকবেও। এই দর্শক নিয়ে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধের একটি পঙ্ক্তি এখানে উদ্ধৃত না করে পারছি না। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘থিয়েটারের দর্শক: অত্যল্প অভিযোগ’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছিলেন— ‘‘রবীন্দ্রসংগীত কিংবা বড়ে গোলাম আলি সাহেবের গান, রবিশঙ্করের সেতার, যামিনী রায়ের ছবি, আধুনিক কবিতা শুনতে বুঝতে পড়তে যেমন নিজস্ব মানসিক শিক্ষার দরকার, ভালো থিয়েটার দেখতেও তাই।’’ এই দর্শক এবং তাঁদের সমালোচনাই তো নাট্যকুশলী ও নাট্যদলের একমাত্র প্রেয় হওয়া উচিত। মূলত রসিক ও বিদগ্ধজনের জন্যই তো এই পঞ্চম বেদ। বিভাস চক্রবর্তী ‘শঙ্খ ঘোষের প্রশংসাসূচক মন্তব্য’ এই প্রসঙ্গেই উল্লেখ করেছিলেন বলে মনে হয়।
অনির্বাণ কি খবর রাখেন, মফস্সলের কতগুলি নাট্যদল আজ দিল্লির অর্থে পুষ্ট হয়ে দিল্লি-মুখাপেক্ষী হয়ে দিন গোনে, কলকাতা থেকে অভিনেতা অভিনেত্রী নিয়ে গিয়ে তাদের দলে অভিনয় করায়, আশি-অতিক্রান্ত বিভাস চক্রবর্তীকে রাতের পর রাত জাগিয়ে অক্লান্ত শারীরিক পরিশ্রম করিয়ে নাট্যমেলা উদ্বোধন করাতে নিয়ে গিয়ে ধন্য হয়? গত এক যুগ ধরে বাংলা নাটকের বর্ষকথা প্রকাশ করার সুবাদে গোটা বাংলার নাট্যদল ও নাট্যজন সম্পর্কে অধিকাংশ সাম্প্রতিক সংবাদ ও তথ্য হাতের কাছে থাকার সুবিধায় এগুলি নিয়ে আমি একটি তালিকা পেশ করতে পারতাম। করলাম না, তার কারণ এগুলি নাট্যজগতে প্রায় সকলেরই জানা।
শেষে বলি, অনির্বাণের লেখায় একটা আত্মম্ভরিতা আছে, নিজের ঢাক নিজেই পিটিয়ে গিয়েছেন তিনি। তাঁর ক’টা শো, ক’টা শো তিনি ছাড়েন, কত দর্শক তাঁর নাটক দেখেন... বালকসুলভ চপলতায় এ সব কথা বলে তিনি হাস্যরসের সৃষ্টি করেছেন। এ সব দিয়ে নাটকের প্রকৃত মূল্যায়ন হয় না। সৎ-শিল্প ও শিল্পী সম্পর্কে সামান্যতম বোধ থাকলে এবং বাংলা নাটককে কিঞ্চিৎ পরিমাণে ভালবাসতে পারলে আজ তিনি মফস্সলের বহু নাট্যদল ও নাট্যকর্মীর অভিভাবক, শিক্ষক বিভাস চক্রবর্তীর দিকে এ ভাবে বাক্য নিক্ষেপ করতে পারতেন না।
মফস্সলে নাটক করার অভিজ্ঞতা থাকায় এক জন মফস্সলের নাট্যকর্মী হিসেবে আমি অনির্বাণের কাছে জানতে চাই, কে তাঁকে মফস্সলের নাট্যদলগুলির প্রতিনিধি করে দিল, কে তাঁকে এক জন প্রবাদপ্রতিম নাট্যগুরুকে এ ভাবে অসম্মানের অধিকার দিল?
মলয় ঘোষ বোলপুর, বীরভূম
ব্যক্তিগত
কলকাতার কসবা এলাকায় নিজের ফ্ল্যাটের মধ্যে আততায়ীর হাতে খুন হলেন এক মহিলা। তিনি একটি কেন্দ্রীয় সংস্থার উচ্চপদস্থ অফিসার ছিলেন। আততায়ী ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনযাপন নিয়ে বিভিন্ন রকম চটুল লেখা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেল। সে সব কথা সত্যি বা মিথ্যে যা-ই হোক, সেগুলি ছাপার ক্ষেত্রে সংবাদপত্রগুলির আরও সংবেদনশীল হওয়া উচিত ছিল। ওই মানুষটি আর বেঁচে নেই, সুতরাং তাঁর বিরুদ্ধে কিছু লেখা হলে তিনি সেটা খণ্ডন করতেও পারবেন না। তা ছাড়া ভেবে দেখা দরকার, তাঁর একটি সামাজিক জীবন ছিল এবং তাঁর পরিবার আছে। তাঁর ও তাঁর পরিবারের সামাজিক ও পারিবারিক সম্মান নষ্ট হয়, এমন তথ্য ছাপার অধিকার সংবাদপত্রগুলিকে কে দিল?
সুজন কুমার দাস জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ই-মেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়