জহর সরকারের ‘আপনি তুমি তুই...’ (২২-৬) শীর্ষক প্রবন্ধটি মনকে অতীতমেদুর করে দিল। মন চলে গেল স্কুলবেলার দিনগুলোতে। আমার অভিজ্ঞতাটি অবশ্য লেখকের অভিজ্ঞতার বিপ্রতীপ। স্কুলে আমাদের অঙ্ক ও বিজ্ঞান পড়াতেন যে স্যর, তিনি যখন স্বাভাবিক মেজাজে থাকতেন তখন ছাত্রদের ‘তুই’ সম্বোধন করতেন। আর কেউ কোনও অঙ্ক ভুল করলে স্যরের মেজাজ যেত বিগড়ে। তখন সম্বোধন ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’ হয়ে যেত! আর আমরা বুঝতে পারতাম ছাত্রটির দিকে তীব্র ভর্ৎসনা ধেয়ে আসতে চলেছে। বহু গুরুজনই এমনটা করতেন।
এটা অবশ্য বছর চল্লিশ আগের কথা। সে দিনের ছাত্র আমি আজ শিক্ষক। সকল পরিস্থিতিতেই যে কোনও ছাত্রকে ‘তুই’ সম্বোধন থেকে বিরত থাকি। শিক্ষকজীবনের সূচনা থেকে প্রায় গত তিন দশক আমি ক্লাসের নিরীহ ছাত্র থেকে দুষ্টু ছাত্র এবং তথাকথিত ভাল থেকে দুর্বল ছাত্র সকলকেই ‘তুমি’ সম্বোধনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আর ছাত্রদের কাছ থেকে ‘আপনি’ সম্বোধনটি শুনতে অভ্যস্ত। স্কুলের নিচু ক্লাসের কোনও কোনও ছোট ছাত্র কখনও কখনও ‘তুমি’ সম্বোধনও করেছে। সে জন্য কোনও দিন অসম্মান বোধ করিনি। বরং ছোট্ট ছেলেটির সরল মুখের ‘তুমি’ সম্বোধন এক রকম ঘরোয়া ও আন্তরিক বলেই মনে হয়েছে। পেশাদার শিক্ষকের বদলে আমাকে বাড়ির নিকটজনের মতোই সে ভাবতে পারছে, এই অনুভবে কিঞ্চিৎ শ্লাঘাও অনুভব করেছি।
তবে চিরকাল তথাকথিত পেশাগত নিম্ন বা উচ্চস্তর অনুযায়ী ‘তুই’, ‘তুমি’, ‘আপনি’ সর্বনামের ব্যবহারটি শুনে আসছি। এখানে বয়সে ছোট বা বড় হওয়াটা সম্বোধনকারীর বিবেচনায় থাকে না। তাই অবলীলায় অনেকেই বয়সে বড় রিকশাওয়ালা, বাজারের আনাজ বিক্রেতা, কৃষক বা মজুর শ্রমজীবী মানুষটিকে ‘তুই’ সম্বোধন করে থাকেন। যা একেবারেই অনুচিত। কিমাশ্চর্যম্! এঁরাই আবার তথাকথিত পদমর্যাদায় উচ্চ কিন্তু বয়সে ছোট মানুষকে ‘আপনি’ সম্বোধন করেন! নেতা বা মস্তান গোছের কেউ হলে তো ‘আপনি’ ও ‘আজ্ঞে’ করতেও দেখি কোনও কোনও মানুষকে! এ তাঁদের সঙ্কীর্ণ মনের পরিচায়ক। বাংলা ভাষায় বয়সে ছোট নিকটজনকে ‘তুই’ সম্বোধনে অবশ্য কোনও অসম্মান থাকে না। বরং সেটা সম্পর্কের নৈকট্য ব্যক্ত করে। কিন্তু অপরিচিত বা স্বল্পপরিচিত বয়সে বড় কিংবা ছোট কোনও মানুষকে ‘তুই’ সম্বোধনে অসম্মান ও অমর্যাদা যুক্ত থাকে তো বটেই। রাস্তাঘাটে তা শুনলে অস্বস্তি হয়। মনে করি, পেশাগত ভাবে যে কাজেই যুক্ত থাকুন না কেন, সকলেরই মর্যাদাপূর্ণ সম্বোধন প্রাপ্য। স্বাভাবিক ভাবেই সে ক্ষেত্রে ‘তুই’-এর বদলে ‘আপনি’ সম্বোধন বেশি উপযুক্ত। স্মরণে আসছে সেই আপ্তবাক্যটি— “আপনার ব্যবহারই আপনার পরিচয়।”
কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া
দাঁড়িপাল্লায়...
জহর সরকারের ‘আপনি তুমি তুই...’ প্রবন্ধটি অত্যন্ত অনুপ্রেরণাদায়ক। এই বিষয়ে অল্পস্বল্প অভিজ্ঞতা সংযোজন করছি। আমার খর্বতনু, ক্ষীণকায় ও অন্য রকম আদলের মুখমণ্ডল দেখে পথে-ঘাটে, বাসে, ট্রেনে, ট্রামে কেউ ভাবতেনই না, এই লোকটির সম্মানজনক ‘আপনি’ সম্বোধনটি প্রাপ্য। কিন্তু আমিই যখন চেয়ারে বসে থাকতাম, তখন যাঁদের কাজ থাকত, তাঁরা অপ্রয়োজনীয় দু’-চারটি বেশি নমস্কার করতেন। এ দেখে আমার মনে হয়েছে, শরীরের আকার এবং পদমর্যাদা উভয়েই ‘আপনি’ সম্বোধনটি আদায় করে। শ্রেণিবিভাজনের সঙ্গেও এটি সম্পৃক্ত। দেখাই যায় যে, শ্রমজীবী মানুষদের আমরা অবলীলায় ‘তুমি’ বা ‘তুই’ বলি, বয়সে বড় হলেও। তবে, তুমি অধম হইলে আমি উত্তম হইব না কেন? আমি নিজে ছোট বড় সকলকেই ‘আপনি’ বলি। প্রত্যুত্তরে কেউ কেউ আমাকেও ‘আপনি’ বলেন। এ ক্ষেত্রে আমিই যে ব্যতিক্রম, তা বলছি না, অনেক শ্রদ্ধাস্পদ ব্যক্তিও সবাইকে সম্মানসূচক ‘আপনি’ শব্দটি ব্যবহারে সম্বোধন করেন। তাঁরা নিরহঙ্কার।
আমার জন্মস্থানের অধুনা শ্রুতিমধুর নাম জঙ্গলমহল। সেই অঞ্চলে স্বাধীনতার পূর্বে বাংলা ভাষা সর্বাংশে প্রবেশ করেনি, আঞ্চলিক কুড়মালি বা চর্যাপদের উপভাষাই একমাত্র অবলম্বন ছিল। বাবাকে ‘বাপ’ বলে ডাকা হত এবং ‘তুঁই’ সম্বোধন করা হত। ‘তুঁই’-এর বাংলা ‘তুই’। এমনকি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদেরও ‘তুমি’ বলা চলত। এখন অবস্থা অনেক পরিবর্তিত হয়েছে।
অনেক সময়ই কাজেকর্মে গ্রামে যাতায়াত করতে হয়েছে। সে সব এলাকায় অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি, পুরুষ তাঁর স্ত্রীকে ‘তুমি’ বলেন না। বলেন ‘তুই’। আবার চরম দাম্পত্যকলহে ‘তুই’ চলে আসে। মানে, ভাবখানা হল— স্ত্রী আমার অধীনে, তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করব কেন? প্রজন্মলালিত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থেকে এর উৎপত্তি। তবে স্ত্রী ‘আপনি’ সম্বোধন করলে ভালবাসা জমে কি?
আর একটি কথা বলার। প্রায় সব সরকারি দফতরে দেখেছি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাঁর অধীনস্থ অন্যান্য আধিকারিক ও কর্মচারীকে ‘তুমি’ করে বলছেন। এটি বেশি শ্রুতিকটু লাগে যখন রাজনীতিবিদেরা উচ্চপদস্থ আইএএস, আইপিএস অফিসারদের ‘তুমি’ সম্বোধন করেন অনায়াসে। এ কোনও আদুরে ডাক নিশ্চয়ই নয়। ইংরেজিতে ‘তুই’, ‘তুমি’, ‘আপনি’ একটি শব্দে চালানো যায় বলে সমস্যা হয় না। কিন্তু বাংলা ভাষায় ‘আপনি’, ‘তুমি’, ‘তুই’... তিনটি অর্থে ব্যবহৃত হয়।
আমাদের সময় গুরুজনেরা যথেষ্ট সম্মান পেতেন। আসলে নীতিশিক্ষা সব সময় বাড়ি থেকেই শুরু হওয়া উচিত। আর তার উপর পালিশ পড়ে, তা নিখুঁত হয় বিদ্যালয় ও সুস্থ পরিবেশে।
সন্তোষ কুমার বেরা,জনকা, পূর্ব মেদিনীপুর
বড়ই অনীহা
জহর সরকারের ‘আপনি তুমি তুই...’ প্রবন্ধটি যে কোনও প্রবীণ মানুষের মনের কথা। ‘আপনি’, ‘তুমি’, ‘তুই’ সম্বোধন নিয়ে নবীন প্রজন্মের ভাবনা কোন পথে চলে, তার বিচার পক্বকেশধারীদের পক্ষে এক প্রকার অসম্ভব। ভাষার বিশুদ্ধতা নিয়ে সচেতনতা আজ তলানিতে। মাতৃভাষা ভাল করে রপ্ত করলে চাকরির বাজারে তা সাহায্য করবে না— অতএব বহু অভিভাবকই সন্তানের বাংলা শিক্ষা নিয়ে যত্নবান নন। সরকারের তরফে সে রকম কোনও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ আমাদের চোখে পড়ে কি?
হিন্দিভাষীরা কাজের তাগিদে এখানে এসে হিন্দিতে কথা বললে আমরাও তাঁদের সঙ্গে হিন্দিতেই কথা বলি। ভাল ভাবে হিন্দি বলতে না পারলে লজ্জিতও হই। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বিভিন্ন রাজ্যে গেলে দেখা যায় সেখানকার ভাষায় দোকানের নাম বা বাসের নম্বর, গন্তব্যস্থল লেখা। অথচ কলকাতা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় বিভিন্ন দোকানের ফলকে বাংলা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অনেকেই দেখেছেন, অন্য রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে উচ্চশিক্ষিত যুবক-যুবতীরা নিজের গ্রাম, শহর বা রাজ্যের মানুষের সঙ্গে মাতৃভাষাতেই কথা বলছেন। সেখানে এই রাজ্যের বাঙালিদের বৃহদংশের মাতৃভাষায় কথা বলায় অনীহা কিন্তু অনেকের অভিজ্ঞতাতেই আছে।
অতীতে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হয়েও শুদ্ধ বাংলায় বক্তব্য পেশ করতে বা লিখতে দেখেছি। লেখক নিজেও এক জন কৃতী বাঙালি। তাই তাঁর অভিজ্ঞতার নির্যাস কলমের মাধ্যমে উঠে আসতে দেখে মনে হল, আশা এখনও হারায়নি!
প্রবাল বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে