Vulgar Language

সম্পাদক সমীপেষু: আগল প্রয়োজন

লেখার ভাষা বা কথা বলার ভাষা দুটোতেই সুরুচি সম্পন্ন ব্যবহারিক প্রয়োগ অবশ্যই প্রয়োজন। তা হলেই ভাষা বাঁচে। অশ্লীল বা কুরুচিপূর্ণ ভাষার প্রয়োগ এক সামাজিক অবক্ষয়ের পরিণতি।

শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০২৫ ০৭:০৭
Share:

আবির্ভাব ভট্টাচার্যের ‘ভাষাটার যত্ন নিচ্ছি কি’ (১৭-৫) শীর্ষক প্রবন্ধটি কথা বলার ভাষা নিয়ে মানুষের মধ্যে সামাজিক চেতনার প্রকট অভাবের প্রতিক্রিয়া। লেখার ভাষা বা কথা বলার ভাষা দুটোতেই সুরুচি সম্পন্ন ব্যবহারিক প্রয়োগ অবশ্যই প্রয়োজন। তা হলেই ভাষা বাঁচে। অশ্লীল বা কুরুচিপূর্ণ ভাষার প্রয়োগ এক সামাজিক অবক্ষয়ের পরিণতি। আজকাল ট্রাম, বাস বা রেলের কামরায় যাত্রাকালে বা অন্য কোনও জনবহুল স্থানে যে অশ্লীল বা কুরুচিপূর্ণ ভাষা শোনা যায় আর অঙ্গভঙ্গি দেখা যায় তা প্রায় প্রত্যেকেরই জানা। অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ কেবল স্কুল বা কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে নয়, অনেক ভদ্রবেশী জনসাধারণের মধ্যেও দেখতে-শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। মেট্রো রেলের কামরায় ভ্রমণকালে দেখা দুই কলেজ পড়ুয়ার কথোপকথনের কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি। এক পড়ুয়াকে সতর্ক করে অন্য পড়ুয়া বলছে, “আরে এ সব খারাপ কথা এখানে বলিস না, এখানে কত লোকজন আছে।” প্রত্যুত্তরে সে বলছে, “আরে ছাড় তো! দেখছিস না আজকাল কত নেতা-মন্ত্রীরাও বলছে। টিভি বা সংবাদপত্র খুললেই দেখতে পাবি। আর এ শব্দগুলো অভিধানেও পরবর্তী কালে চলে আসবে। এগুলো ছাড়া কথাবার্তা সম্পূর্ণ হয় কি?”

লক্ষ লক্ষ লোকের জনপ্রতিনিধি নেতা বা মন্ত্রীদের মুখে লাগাম বলে আর সত্যিই কিছু নেই। শুধুই গালিগালাজ আর নিন্দার ধ্বনিতে পরস্পরের বাগ্‌যুদ্ধ। সত্যিই অবাক হতে হয় দেখে যে কী অশ্লীল ভাষ্যে কিছু নেতা-মন্ত্রী পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করেন। দোষারোপ বা প্রতিবাদ করলে কেন তার মাধ্যম মার্জিত ভাষা হবে না?

ভাষা যখন আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য, আমাদের জাতিগত পরিচয় বহন করে তখন সে ভাষার প্রতি যত্নশীল হওয়া প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তা না করে অশ্লীল বা কদর্য ভাষার প্রয়োগ বা ব্যবহারের দ্বারা নিজেদের ভাষাকে অসম্মান করছি। আমাদেরও কোথাও খামতি থেকে যাচ্ছে নব প্রজন্মকে ঠিক ভাষা প্রয়োগে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে।

স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০

গরলধারা

আবির্ভাব ভট্টাচার্যের ‘ভাষাটার যত্ন নিচ্ছি কি’ শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। অসংযত, অশোভন ভাষা ব্যবহারের উৎকট প্রকাশ আজ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শহুরে ব্যস্ত জীবনে হিন্দি ইংরেজি মেশানো উদ্ভট ভাষা এবং অপশব্দের যৌন-ইঙ্গিতবাহী শ্লেষের কাছে হার মানছে সুস্থ রুচির সমৃদ্ধ বাংলা ভাষা।

এই অপভাষার হিংসাশ্রয়ী আচরণের বীজটি কিন্তু নিহিত আছে আমাদের দৈনন্দিন যাপনের আধারেই। আক্ষরিক অর্থেই আজ কান পাতলেই শোনা যায় অপভাষার অবিশ্রাম গরলধারা। বস্তুত, ভোট প্রচারের ময়দান থেকে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, সর্বত্র কুকথা যেন এ দেশের রাজনীতির শিরোভূষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অশ্রাব্য ভাষার বহুমাত্রিক লাগামছাড়া প্রয়োগ দেখে আজ শিউরে উঠতে হয়। খেলার মাঠে বিপক্ষ দলের প্রতি চোখা চোখা বিশেষণ প্রয়োগ থেকে রোগ নির্ণয়ে ত্রুটির কারণে উন্মত্ত জনতা কর্তৃক চিকিৎসকের উদ্দেশে কটূক্তি বর্ষণ, মহানগরীর রাজপথে বাস-কন্ডাক্টরের বিরুদ্ধে অধৈর্য নিত্যযাত্রীদের বাছাই করা শব্দবাণ, ক্ষেত্রবিশেষে পুলিশ বা সিভিক ভলান্টিয়ারদের মুখনিঃসৃত অপশব্দ বা পড়ুয়াদের প্রতি কখনওসখনও এক শ্রেণির শিক্ষকের জাতিবিদ্বেষমূলক মন্তব্য, ভিড় বাস বা ট্রেনের কামরায় সিট দখলে যুযুধান দু’পক্ষের স্বভাবোচিত অপশব্দ ব্যবহার যেন অতি তুচ্ছ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাস্তব দুনিয়ার সমান্তরালে নেটজগতেও দেখা যায় কুৎসিত ভাষায় নানা লেখা। তার সহচর হয়ে সেখানে মাঝে-মধ্যেই উঠে আসে কিছু অশালীন শব্দে ভরপুর ভিডিয়ো। এর মূলে আছে সমাজের বিকারগ্রস্ত অংশের নিম্নরুচি।

প্রকৃতপক্ষে, মনের অলিন্দে জমে থাকা অবদমিত ক্ষোভ, হতাশা ও জিঘাংসার কুৎসিত আধারেই ‘বাচিক হিংসা’র সর্বগ্রাসী রূপটি তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে থাকে। ভাষাসন্ত্রাসের এ-হেন অসহিষ্ণুতার চোরাবালিতে হারিয়ে যায় আমাদের স্নেহময় শীতল বাংলা ভাষার উদারবাদী সমৃদ্ধ ও সহিষ্ণু চরিত্রটি। তাকে রক্ষা করার শুভ চেতনার পাঠ শুরু হোক নিজ গৃহকোণ থেকেই।

সুপ্রতিম প্রামাণিক, আমোদপুর, বীরভূম

মর্যাদা দিন

‘ভাষাটার যত্ন নিচ্ছি কি’ শীর্ষক প্রবন্ধে বাংলা ভাষা চর্চার ক্রমবর্ধমান সঙ্কটের কথা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলা ভাষা ক্রমেই মর্যাদা হারাচ্ছে। একটু আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন পরিবার সন্তানকে বাংলা মাধ্যম স্কুলে বর্তমানে ভর্তি করায় না। শহরে-নগরে তো বটেই, শহরতলি এমনকি গ্রামে-গঞ্জে পর্যন্ত বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি শিক্ষার্থী-সঙ্কটে ভুগছে। শহরের পর মফস্‌সলেও ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থাবা বসিয়েছে। অর্থনৈতিক সঙ্গতিসম্পন্ন ও অভিজাত বাঙালি পরিবারে বাঙালিয়ানা আস্তে আস্তে উধাও হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে ইংরেজির দাপট। আর এক জগাখিচুড়ি মার্কা বাংলার দাপট বাড়ছে। সমাজমাধ্যমে অনেকে বাংলা লেখেন রোমান হরফে। কোনও একটি ভাষায় বিশেষ পারদর্শী হতে গেলে অন্য ভাষাকে অবহেলার প্রয়োজন নেই। অথচ এখনও বহু মানুষ আছেন যাঁরা বাংলা, ইংরেজি, দুটোই ভাল জানেন। তার পরও মাতৃভাষা চর্চা নিয়ে এক ধরনের উন্নাসিকতা রয়েছে।

সমাজমাধ্যমে বাংলা ভাষার বিকৃত রূপ প্রায় নিয়মে এসে দাঁড়িয়েছে। হামেশাই দেখতে পাচ্ছি আমরা-কে ‘আমড়া’, পরা-কে ‘পড়া’, ঝরছে-কে ‘ঝড়ছে’-র মতো বানান-বিকৃতি। কুকথা ব্যবহার প্রসঙ্গে বলতে দ্বিধা নেই যে ভাষার এই পিতৃতান্ত্রিক অভ্যাস সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। বাসে-ট্রেনে, খেলার মাঠে, তরুণ কবিদের জটলায়, এমনকি প্রৌঢ় পক্বকেশ সঙ্গীতবিশারদকেও শ্রোতাদের সঙ্গে এই ভাষাতেই বার্তালাপ করতে দেখেছি।

বদল দরকার আমাদের চিন্তায়, মানসিকতায়। বর্তমান যুগে সকল দ্বার রুদ্ধ করে বাঁচা সম্ভব নয়। তার প্রয়োজনও নেই। শুধু দরকার একটু মেলবন্ধনের। ইংরেজি বা হিন্দি ভাষা শেখার প্রয়োজন কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। সঙ্গে বাংলা ভাষাও থাকুক আমাদের সকলের আন্তরিক চর্চায়, ভালবাসায়, আবেগের ভাষা হয়ে।

সাহিত্যই ভাষাকে টেনে নিয়ে যেতে পারে আগামী দিনে, সুদূর ভবিষ্যতে। বাংলা ভাষার সংস্কৃতিকে রক্ষা ও সমৃদ্ধ করার দায় তাই কবি-সাহিত্যিকদেরই নিতে হবে।

সৌম্য বটব্যাল, দক্ষিণ বারাসত, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

মিলনগীতি

আবির্ভাব ভট্টাচার্যের ‘ভাষাটার যত্ন নিচ্ছি কি’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। আমার মতে, ১৯ মে তো ভাগ্যবান, অন্তত দুয়োরানির মর্যাদা পাচ্ছে। কিন্তু ১ নভেম্বর? তারিখটার তাৎপর্য কী, প্রশ্ন করলে বেশির ভাগ বাঙালি সম্ভবত মাথা চুলকাবেন। এই উপমহাদেশের দীর্ঘকালীন (১৯১২-৫৬) বাংলা ভাষা আন্দোলনের পরিণতিতে ১৯৫৬-র ১ নভেম্বরে বিহারের বাংলাভাষী-প্রধান মানভূম জেলার ১৬টি থানা নিয়ে পুরুলিয়া জেলা পশ্চিমবঙ্গের অর্ন্তভুক্ত হয়।

তবে অনেক হিন্দি শব্দ বাংলা ভাষায় মিশে আমাদের ভাষাটাকেও সমৃদ্ধ করেছে। ষাটের দশকে যখন সিনেমা হল, বড় বিপণিগুলোতে ঘর ঠান্ডা করার যন্ত্র বসানো হল তখন বিজ্ঞাপনে লেখা থাকত ‘শীতাতপনিয়ন্ত্রিত’। পরে হিন্দি ভাষা থেকে সহজতর ‘বাতানুকূল’ শব্দটা জুড়ল প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহারিক বাংলায়। লোকসভা বা বিধানসভার সদস্যদের আমরা এখনও একটা স্বকীয় বাংলা প্রতিশব্দে সংজ্ঞায়িত করতে পারলাম না। এখন বহুল প্রচলিত ‘সাংসদ’, ‘বিধায়ক’ শব্দগুলো। অন্য ভাষার শব্দ মিশে যাওয়া একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। গ্রহণ বর্জন নির্ভর করে মানুষের পছন্দ আর রুচির উপর।

বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়, কুলটি, পশ্চিম বর্ধমান

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন