ভারতের গণতন্ত্র কি ঠিক পথে

দুর্ভাগ্যের হলেও এটাই সত্যি, এমন এক আশঙ্কা ক্রমেই গ্রাস করছে আমাদের। দেখা যাচ্ছে, একজন নেতা যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। নিজের ইচ্ছাকেই জনগণের মাথায় চাপিয়ে দিচ্ছেন। নির্বাচনের পূর্বে ইস্তাহারে জনগণের কাছে নিজেকে তুলে ধরা হচ্ছে কল্পতরু রূপে। লিখলেন প্রশান্ত কুমার দাস।দুর্ভাগ্যের হলেও এটাই সত্যি, এমন এক আশঙ্কা ক্রমেই গ্রাস করছে আমাদের। দেখা যাচ্ছে, একজন নেতা যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। নিজের ইচ্ছাকেই জনগণের মাথায় চাপিয়ে দিচ্ছেন। নির্বাচনের পূর্বে ইস্তাহারে জনগণের কাছে নিজেকে তুলে ধরা হচ্ছে কল্পতরু রূপে। লিখলেন প্রশান্ত কুমার দাস।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০৪
Share:

প্রতীকী: ভোটের সচেতনতা বাড়াতে শান্তিনিকেতন রাস্তায় আঁকা হয়েছে ইভিএম। —ফাইল চিত্র।

আজ থেকে ৭২ বছর আগে অনেক মনীষী ও দেশপ্রেমিকের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ভারত স্বাধীনতা লাভ করেছিল। রচিত হয়েছিল পবিত্র সংবিধান, যেখানে ভারতবর্ষকে বলা হয়েছে, সার্বভৌম, সমাজতন্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বি আর অম্বেডকরের অক্লান্ত চেষ্টায় সুবৃহৎ লিখিত সংবিধান রচিত হয়েছিল। এই সংবিধানের জন্য আমরা গর্বিত। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসাবে ভারতের কিছু খ্যাতির কথা তুলে ধরা হয়। যেমন, সেনাবাহিনীর উপরে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারের নিয়ন্ত্রণ, কোটি কোটি মানুষের নির্বাচনে শামিল হওয়া, বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রভৃতি।

Advertisement

আজ আবার এক সাধারণ নির্বাচনের মুখে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগছে, আমাদের দেশের গনতন্ত্র কোন পথে পরিচালিত হচ্ছে? আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের সংজ্ঞা অনুযায়ী, গণতন্ত্র বলতে বোঝায় ‘বাই দ্য পিপল, অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল’। অর্থাৎ জনগণের দ্বারা, জনগণের এবং জনগণের জন্য। এর অর্থ হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে জনগণের হাতেই রাষ্ট্রের ক্ষমতা থাকবে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তাই-ই কি হচ্ছে? বিরোধী দলগুলি সমস্বরে বলছে, মোটেও না। বরং সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের মুখে ভারতের গণতন্ত্রই চ্যালেঞ্জের মুখে বলে দাবি করছেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।

একটা বিতর্ক হামেশাই শোনা যায়, গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ভাল নাকি আমাদের এক জন অত্যন্ত শক্তিশালী নেতা প্রয়োজন? সেই প্রশ্নটা এ বারের নির্বাচনে যেন আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু, শক্তিশালী নেতা বলতে কী বোঝায়? যিনি একনায়কের মতো নিজের হাতে দেশের সমস্ত ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করে রাখবেন? যাঁর কথাতেই দল চলবে, সরকার চলবে। যিনি ছাতি ঠুকে বলবেন, আমি এই করেছি, আমি ওই করেছি? বিরুদ্ধ মত শোনা হবে না?

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

দুর্ভাগ্যের হলেও এটাই সত্যি, এমন এক আশঙ্কা ক্রমেই গ্রাস করছে আমাদের। দেখা যাচ্ছে, একজন নেতা যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। নিজের ইচ্ছাকেই জনগণের মাথায় চাপিয়ে দিচ্ছেন। নির্বাচনের পূর্বে ইস্তাহারে জনগণের কাছে নিজেকে তুলে ধরা হচ্ছে কল্পতরু রূপে। আগের ভোটে সেই নেতা বলেছিলেন, বিদেশ থেকে কালো টাকা উদ্ধার করে প্রতিটি মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করে দেবেন, কখনও বলেন ২ কোটি বেকারের চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু, সে-সব আদৌ বাস্তবায়িত হল কিনা, তা ঠিক করে দেবে কে? এ কেমন দেশ, যেখানে জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে, এমনকি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরামর্শ ছাড়াই এক রাতের ঘোষণায় সচল টাকাকে অচল ঘোষণা করে দেওয়া হচ্ছে? বলা হচ্ছে, কয়েক দিনের মধ্যে পুরনো নোট বদল করে নিতে হবে।

সেই দিনগুলির স্মৃতি এত সহজে ভোলা যায় না। আমজনতার মধ্যে তুমুল হুড়োহুড়ি পড়ে গেল, লাইন দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে প্রাণ গেল ক’জনের। স্রেফ এক জনের ইচ্ছাকে মান্যতা দিতে গিয়ে। এর নামই কি গণতন্ত্র? বিরোধীরা তাই প্রশ্ন তুলছেন, একটা গণতন্ত্র রাষ্ট্রের প্রধান হয়ে কেই কি এরূপ একক ভাবে কোনও কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘোষণা করতে পারেন?

এ ছাড়া গণতন্ত্রের একটা বড় দিক হল মৌলিক অধিকার। যেমন বাক স্বাধীনতা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কেউ বিরুদ্ধমত প্রকাশ করলেই তাকে দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে কিংবা গ্রেফতার করা হচ্ছে। কয়েক দিন আগেই বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘প্রথম দেশ, তার পরে দল, তারও পরে নিজে’। তাঁর কথায়, ‘ভারতীয় গণতন্ত্রের সারাংশ বৈচিত্র্য এবং বাক স্বাধীনতার সম্মান।’ তিনি ঠিকই বলেছেন। দেশের মানুষের কল্যাণই হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। কিন্তু, হয় তার উল্টো। প্রথমে নিজের উন্নতি, তার পরে দলের উন্নতি এবং শেষে কিছু বাঁচলে আম জনতার কথা ভাবা হচ্ছে। তাই দেশের এক বড় অংশের মানুষ দিনের পর দিন বঞ্চনার শিকার।

এই বৈষম্য, অসাম্য শুধুই এখনকার সময়ের—এমন বলে দেওয়াটা উচিত হবে না। বরং স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকেই এই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরেই প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ঘোষণা করেছিলেন—কালোবাজারি ও চোরাকারবারিদের রাস্তায় ল্যাম্পপোষ্টে ঝুলিয়ে মারতে হবে। কিন্তু সেটা কোনও দিনই বাস্তবায়িত হয়নি। বরং সময় যত এগিয়েছে, কালোবাজারিদের দাপট ততই বেড়েছে। পরবর্তী কালে ইন্দিরা গাঁধী প্রধানমন্ত্রী হয়ে ঘোষণা করলেন ‘গরিবি হটাও’। কিন্তু দুর্ভাগ্য, গরিবি বা দারিদ্র ঘুচল না। বরং দিনের পর দিন বাড়তে থাকল। এ দেশে সম্পদ বণ্টনের অসাম্য আরও মারাত্মক এক দিক। এক দিকে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, গরিবেরা আরও গরিব হচ্ছে। আজও দেশের বড় অংশের দু’বেলা অন্ন জোটে না। অন্ন বস্ত্র বাসস্থান স্বাস্থ্য শিক্ষা সাধারণ মৌলিক চাহিদাটাও তাদের জুটছে না। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ গুনার মিরডালের মতে, “ভারতের জনসাধারণ নিতান্ত দারিদ্রগ্রস্ত। কিন্তু জাতীয় রাজনৈতিক নেতারা সুবিধাভোগী এক উচ্চশ্রেণির মানুষ। নতুন দায়িত্ব ও ক্ষমতা তাদের জন্য আরও অধিক সুবিধাভোগের সুযোগ সৃষ্টি করে।’’

এখন সপ্তদশ লোকসভার নির্বাচনের প্রাক্কালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আবার কল্পতরুর ভূমিকা পালন করছে। তারা নতুন নতুন স্লোগান দিচ্ছে। কোনও দলের নেতা বলছেন, নির্বাচনে জিতলে দেশের দারিদ্রনিধন যজ্ঞ হবে অর্থাৎ দেশে দরিদ্র কেউ থাকবে না। সরকার গঠন করতে পারলে ২৫ কোটি দারিদ্রতম লোকের ব্যাঙ্কে বছরে ৭২ হাজার টাকা পৌঁছে দেবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এক তরুণ নেতা। জানি না, এই ঘোষণার পরে ক্ষমতায় এলে প্রকৃত দারিদ্র-নিধন হবে কিনা। স্বাধীনতার ৭২ বছর পরেও ভারতের গণতন্ত্রের সমাধি রচনা প্রত্যক্ষ করছি। অসংখ্য রাজনৈতিক মতবাদের পঙ্কিল আবর্তে সনাতন ভারতীয় মূল্যবোধ আজ হাবুডুবু খাচ্ছে। যে রাজনীতি ব্যাক্তিগত ও দলীয় স্বার্থকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেই রাজনীতি আর যাই হোক, দেশাত্মবোধের জাগরণ ঘটাতে পারে না।

ভোটে জেতার জন্য অধিকাংশ দল নানা ভাবে ভোটারদের প্রভাবিত করে। আমাদের দেশের ৩০ শতাংশ লোক এখনও অশিক্ষিত। তাঁরা সহজেই নানা প্রকার প্রলোভনে বিচলিত হচ্ছেন। আবার নির্বাচনের আগে এক দলের নেতা অন্য দলে যোগ দিচ্ছেন, টিকিট পাওয়ার আশায়। অনেকে টিকিট পেয়েও যাচ্ছেন। আমাদের রাজ্যেই এমন নজির আছে অনেক। কিন্তু তিনি যে অঞ্চলের মানুষের ভোটে বিধায়ক বা সাংসদ হয়েছেন, তাঁদে প্রতি কি বিশ্বাসঘাতকতা করা হচ্ছে না? এ প্রশ্ন তোলার কেউ নেই। এই সব কারণে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য পদে পদে বিঘ্নিত হচ্ছে।

দীর্ঘদিন আগে মহাত্মা গাঁধী বলেছিলেন, “স্বরাজ, সু-রাজ তো শুধুমাত্র স্ব-শাসন বা স্বাধীনতা নয়, এর ব্যাপকার্থ, ভারতীয় পথে দেখা, চিন্তা করা এবং উন্নয়নে বাস্তবোচিত পদ্ধতি গ্রহণ করা। আত্মশক্তির উদ্বোধন ঘটানো, যার সাহায্যে দেশ তার চিরাচরিত পথে পরিবেশের অনুষঙ্গ বজায় রেখে বিশাল ভারতের প্রতিটি মানুষের উন্নতি ঘটাতে পারে।’’ গাঁধীজীর এই পথকেই আমাদের অনুসরণ করার প্রয়োজন রয়েছে। আজকের ভারতে তা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। সমস্ত রকম সঙ্কীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির অবলুপ্তি ঘুচিয়ে জাগিয়ে তোলা দরকার জাতীয় সংহতি। বুঝতে হবে, গণতন্ত্রই ভারতের শক্তি ও যে কোনও মূল্যে গণতন্ত্রকে রক্ষা করাই কর্তব্য।

(লেখক বাজিতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ‘উঃমাঃ’ প্রধান শিক্ষক, মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন