প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নটিও জরুরি

দলিত-আদিবাসীদের নিয়ে রাজনৈতিক দল কম হয়নি, কিন্তু সেখানে প্রাধান্য পায় সেই জাত বা গোষ্ঠী, যারা সংখ্যায় বেশি। আঘাড়ি কিন্তু বৃহৎকে গুরুত্ব দেয়নি, দিয়েছে বৈচিত্রকে।

Advertisement

আবীর দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৯ ০০:০১
Share:

সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে জয়, এই কি নির্বাচনের উদ্দেশ্য? আসন জেতার থেকে প্রার্থীর তালিকাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে মহারাষ্ট্রের ‘বঞ্চিত বহুজন আঘাড়ি’। মরাঠি ভাষার ‘আঘাড়ি’ শব্দের অর্থ ‘মঞ্চ’। সমাজে বঞ্চিত, কোণঠাসা নানা গোষ্ঠীর মানুষেরা এক হয়েছেন এই জোট বা মঞ্চে। বাবাসাহের অম্বেডকরের নাতি প্রকাশ অম্বেডকর ও তাঁর দলের (ভারতীয় রিপাবলিকান পক্ষ— বহুজন মহাসঙ্ঘ) নেতৃত্বে এই মঞ্চ এখনও অবধি প্রার্থীদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে তফসিলি জাতি, জনজাতির প্রার্থীরা তো আছেনই, আছেন যাযাবর জাতি, ব্রিটিশ আমলে ‘অপরাধপ্রবণ’ বলে চিহ্নিত জাতির প্রার্থীরাও। এমন সব প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষ আঘাড়ির প্রার্থী তালিকায় জায়গা পেয়েছেন, যাঁরা কোনও দিন দিল্লির সংসদের ধারেকাছেও আসতে পারেননি। দলীয় পদে নিয়োগের সময়েও প্রতিনিধিত্বের ধারণা গুরুত্ব পাচ্ছে। মঞ্চের অন্যতম মুখপাত্র নিযুক্ত হয়েছেন পুণের সাংস্কৃতিক কর্মী, রূপান্তরকামী দিশা পিঙ্কি শেখ।

Advertisement

দলিত-আদিবাসীদের নিয়ে রাজনৈতিক দল কম হয়নি, কিন্তু সেখানে প্রাধান্য পায় সেই জাত বা গোষ্ঠী, যারা সংখ্যায় বেশি। আঘাড়ি কিন্তু বৃহৎকে গুরুত্ব দেয়নি, দিয়েছে বৈচিত্রকে। বিভিন্ন জাতি, জনজাতির ছোট ছোট গোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্বে নিয়ে এসেছে। অথচ সংখ্যায় যাঁরা অল্প, ভোটের হিসেবে নগণ্য, তাঁদেরও রাজনৈতিক সংগঠনের অংশ করা, বক্তব্য প্রচারের সুযোগ করে দেওয়া গণতন্ত্রের কাজ।

‘বহুজন’ কথাটি কাঁসিরাম চালু করেছিলেন। অব্রাহ্মণ মানুষ, যাঁরা সংখ্যায় অধিক, তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বোঝাতে। প্রকাশ অম্বেডকর তার সঙ্গে যোগ করেছেন ‘বঞ্চিত’ শব্দটি। বাজারি অর্থনীতির আগ্রাসনে যাঁরা আর্থিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত, জাতপাতের রাজনীতির জন্য মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, নাগরিক জীবনে যোগদান এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের থেকে বঞ্চিত, তাঁরাই ‘বঞ্চিত বহুজন’। অর্থনীতি-রাজনীতিতে কোণঠাসা জনগোষ্ঠীদের একটা ‘শ্রেণি’ বলে দেখছে আঘাড়ি। সেই শ্রেণির হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদারি দিতে চাইছে।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

কী ভাবে ছোট জনগোষ্ঠীগুলিকে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব থেকে দূরে রাখা হচ্ছে? সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে প্রকাশ অম্বেডকর একটি দৃষ্টান্ত দেন। যাযাবর জাতি ‘ধাঙড়’ (পেশায় মেষপালক) রাজ্যের জনসংখ্যার ১১ শতাংশ। পশ্চিম মহারাষ্ট্র এবং মরাঠওয়াড়াতে এঁদের সংখ্যা যথেষ্ট। রাজ্যে ক্ষমতায় আসার আগে বিজেপি-জোট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তাঁদের তফসিলি জনজাতি ঘোষণা করবে। সেই প্রতিশ্রুতি তারা রাখেনি। উপরন্তু যে সব নির্বাচন ক্ষেত্রে ধাঙড় জনসংখ্যা বেশি, সেগুলোকে জনজাতির জন্য সংরক্ষিত করেছে নির্বাচনক্ষেত্র সীমা নির্ধারণ কমিশন। ফলে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে ধাঙড়েরা ক্রমশ কোণঠাসা হয়েছেন।

লক্ষণীয়, গত বছর ২ অক্টোবর কৃষকদের নিয়ে এক মহা-অধিবেশনে বঞ্চিত বহুজন আঘাড়িতে যোগ দেয় ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস এ ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’, যার নেতা আসাউদ্দিন ওয়াইসি। মহারাষ্ট্রের বহুমাত্রিক, বিশালাকার জাতপাত-বিরোধী আন্দোলনের রাজনৈতিক ধারক-বাহক হয়ে উঠেছে এই জোট। মুম্বইয়ের বিখ্যাত শিবাজি পার্কে আঘাড়ির ডাকা সম্মেলনে দু’লক্ষের উপর মানুষ এসেছিলেন ২৩ ফেব্রুয়ারি। আঘাড়ির নানা সমাবেশে কৃষকদের সঙ্কট, আদিবাসীদের জমি হারানোর সঙ্কট, প্রান্তবাসীদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য বঞ্চনার কথা তুলে ধরা হচ্ছে। মুম্বইতে ঐতিহাসিক অম্বেডকর ভবন (যেখানে বাবাসাহেব ভারতীয় বৌদ্ধ সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বসিয়েছিলেন মুদ্রণ যন্ত্র) ২০১৬ সালে গুঁড়িয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে, দলিত-আদিবাসীদের প্রতি অপরাধের প্রতিকার করার আইনকে দুর্বল করার বিরুদ্ধে, এবং ভীমা-কোরেগাঁওতে অম্বেডকরপন্থীদের উপর হামলার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিচ্ছেন প্রকাশ অম্বেডকর। গত দুই বছর ধরে আপসহীন প্রচার ও প্রতিবাদ প্রকাশের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়েছে। আঘাড়ির প্রতিবাদ ও আক্রমণের প্রাথমিক লক্ষ্য অবশ্যই হিন্দুত্ববাদী সঙ্ঘ পরিবার, যা মহারাষ্ট্রে ব্রাহ্মণ্যবাদ স্থাপনের প্রধান রূপকার। একই সঙ্গে কংগ্রেসের ‘নরম হিন্দুত্ব’ও তাদের নিশানায়।

মহারাষ্ট্রের বহু এলাকায় আঘাড়ির ডাকে জমায়েত মানুষের সংখ্যা ছাড়িয়েছে কংগ্রেস কিংবা জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস (এনসিপি) সমাবেশকে। কিছু দিন আগেও শোনা যাচ্ছিল, ‘দলিত’ অম্বেডকর এবং ‘মুসলিম’ ওয়াইসি বিজেপির বিরোধিতা করতে হাত মেলাবে কংগ্রেস-এনসিপি জোটের সঙ্গে। প্রশ্ন অবশ্য ছিলই। উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিত্বকারী কংগ্রেস, মরাঠাদের এনসিপি। তাদের সঙ্গে আঘাড়ি হাত মেলানো কত দূর সম্ভব, সেটা নিয়ে।

২০১৪ সালে কংগ্রেস-এনসিপি জোট মাত্র ছ’টা আসন পাওয়া সত্ত্বেও এই জোটই বিজেপির প্রধান বিরোধী, আর তাদের ভোটে ফাটল ধরাবে আঘাড়ি, এটাই ভাবা হচ্ছিল। এর সঙ্গে কিন্তু মনে রাখতে হবে, ‘বঞ্চিত’ জনগোষ্ঠীর অনেকেই ২০১৪ সালের বিজেপিকেই ভোট দিয়েছিল। কে কার ভোট ভাঙায়, ফলই বলবে। তবে শেষ বিচারে আঘাড়ির তাৎপর্য তার নির্বাচন জেতার সম্ভাবনায় নয়। মহারাষ্ট্রের জনসমাজে যে সব বিতর্ক-বিবেচনা টেনে এনেছে আঘাড়ি, সেটাই তার প্রধান গুরুত্ব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন