নোটবদলের লাভ-ক্ষতি

বছরে কতগুলো নোট ছাপা হল, রিজার্ভ ব্যাংক তার বার্ষিক রিপোর্টে সেই সংখ্যাটা জানায়। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে দেশে মোট ১৬০০ কোটি ৫০০ টাকার নোট আর ৬০০ কোটি হাজার টাকার নোট ছিল।

Advertisement

সৌম্যকান্তি ঘোষ

শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৭ ০৬:১০
Share:

নোটবাতিলের পর ন’মাস কেটে গিয়েছে। পাঁচশো আর হাজার টাকা মূল্যের যত নোট বাতিল হয়েছিল, নতুন নোটে তার ৮৪ শতাংশ বাজারে নগদ হিসেবে ফিরে এসেছে। এই টাকার পাঁচ শতাংশেরও কম ব্যাংকে আর এটিএম-এ রয়েছে। বাকি বাজারেই ঘুরছে। নোট বদলের কাজ প্রায় সম্পূর্ণ। এখন দুটো প্রশ্ন। এক, এটিএম থেকে কি গ্রাহকরা তাঁদের প্রয়োজনমত টাকা পাচ্ছেন? দুই, নোটবদল করে লাভ কী হল?

Advertisement

বছরে কতগুলো নোট ছাপা হল, রিজার্ভ ব্যাংক তার বার্ষিক রিপোর্টে সেই সংখ্যাটা জানায়। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে দেশে মোট ১৬০০ কোটি ৫০০ টাকার নোট আর ৬০০ কোটি হাজার টাকার নোট ছিল। দেশে মোট যত নগদ ছিল, এই দুই গোত্রের নোটে ছিল তার যথাক্রমে ৪৮ ও ৩৮ শতাংশ টাকা। তা ছাড়াও খুচরো নোট (১০০ টাকা বা তার কম মূল্যের) ছিল ৬৯০০ কোটি— দেশের মোট নগদের ১৪ শতাংশ ছিল খুচরোয়।

২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে রিজার্ভ ব্যাংক ২৪৬০ কোটি নোট ছাপানোর বরাত দিয়েছিল। ধরে নিলাম, টাঁকশালগুলো সব নোট ছাপাতে পেরেছে— নোটবদলের ধাক্কায় যে বাড়তি নোট ছাপানোর প্রয়োজন হয়েছিল, তা সমেত। বাজারে এখন খুচরো টাকার নোটের সংখ্যা আনুমানিক ৩৭০০ কোটি। তার অর্থমূল্য দেশের মোট নগদের ২৮ শতাংশ (আগে ছিল ১৪ শতাংশ)। ধরে নেওয়া যাক, বাকিটা ৫০০ আর ২০০০ টাকা মূল্যের নোটে সমান পরিমাণে ছাপা হয়েছে— মোট নগদ মূল্যের ৭২ শতাংশ (তার মধ্যে ৫০০ টাকার মোটের সংখ্যা ১২০০-১৩০০ কোটি, ২০০০ টাকার নোট ২০০ কোটি)। তা হলে দাঁড়ায়, নোটবাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে দেশের বাজারে মোট যত নগদ টাকা ছিল, ফের সেখানে পৌঁছোতে গেলে আরও আড়াই লক্ষ কোটি টাকা মূল্যের নোট ছাপাতে হবে। এই ফাঁক পূরণেই প্রস্তাবিত ২০০ টাকার নোটের গুরুত্ব।

Advertisement

নোটবাতিলের পর আরও বেশি করে খুচরো টাকা বাজারে আনার যে চেষ্টা হয়েছে, তা ওপরের পরিসংখ্যানে স্পষ্ট। কিন্তু ২০০০ টাকার পরেই যদি ৫০০ টাকা হয়, তা হলে টাকা খুচরো করার ঝামেলা মারাত্মক। এ দিকে, বেশির ভাগ এটিএম মেশিনেই এক বারে ১০,০০০টির বেশি নোট ভরা যায় না। ফলে, সেই মেশিন ১০০ টাকার নোটে বোঝাই করলে বারে বারে টাকা ভরার বাধ্যবাধকতা থাকে। তার খরচ প্রচুর। আবার, খুচরো পাওয়া যায় না বলে ২০০০ টাকার নোট নিতেও মানুষের আপত্তি। ২০০ টাকার নোটটা জরুরি।

তা হলে প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা কী দাঁড়াল? হ্যাঁ, এটিএম থেকে খুচরো টাকা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু, ২০০ টাকার নোট বাজারে না এলে মেশিনে বারে বারে খুচরো ভরার সমস্যা থাকছে। রিজার্ভ ব্যাংক কিন্তু নোটের মূল্যের পরিমাণ বাজারে মোট নগদের ৮৩-৮৪ শতাংশে বেঁধে রেখেছে, অর্থাৎ ২০০ টাকার নোট যে আসতে চলেছে, তার ইঙ্গিত স্পষ্ট।

এ বার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। বলা হয়েছিল, নোট বদল হলে ভারতীয় অর্থনীতি আরও বেশি করে ব্যাংকিং ব্যবস্থার অধীনে আসবে। জনধন যোজনা চালু হওয়ার আগে বিদেশে কর্মরত ভারতীয়রা দেশে যে টাকা পাঠাতেন, তার ৭০ শতাংশই আসত ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরের পথে। চিনে এই অনুপাতটি মাত্র ৩০ শতাংশ। ফলে, ভারতে ব্যাংকগুলোর সামনে বিপুল সুযোগ ছিল।

এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ, আর এপ্রিল থেকে জুন, এই দুটি ত্রৈমাসিকে পর পর দু’বার মিউচুয়াল ফান্ডে খাটতে থাকা টাকার পরিমাণ (যাকে বলে অ্যাসেট আন্ডার ম্যানেজমেন্ট বা এইউএম) গত বছরের এই দুই ত্রৈমাসিকের তুলনায় ৩৫ শতাংশ হারে বাড়ল। নোটবাতিলের আগে এই হার সাধারণত ১৫-২৫ শতাংশের মধ্যে থাকত। নোটবাতিলের পর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলিতে মোট যত টাকা জমা পড়েছিল, আমাদের হিসেব, তার মধ্যে এক লক্ষ আঠারো হাজার কোটি টাকা মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নি হিসেবে গিয়েছে।

গত নভেম্বর থেকে এই জুনের মধ্যে বিমার প্রিমিয়াম হিসেবেও বাড়তি ২২০০ কোটি টাকা জমা পড়েছে। প্রিমিয়ামের গড় পরিমাণও গত বছরের তুলনায় ১০,০০০ টাকা বেড়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, মানুষ এককালীন প্রিমিয়াম হিসেবে টাকা জমা দিচ্ছেন। এর অর্থ, প্রিমিয়াম না দেওয়ায় পচে যাওয়া বিমা পলিসির সংখ্যা কমবে। জনধন অ্যাকাউন্টেও জমা পড়েছে বাড়তি ১০,০০০ কোটি টাকা। কিন্তু, প্রায় তিন লক্ষ কোটি টাকার আমানত এখনও ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যেই থেকে গিয়েছে। অনুমান ছিল, এই টাকা দ্রুত বেরিয়ে যাবে। কিন্তু, তা হয়নি। অনুমান হচ্ছে, টাকাটা পাকাপাকি ভাবে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় থেকে গেল। অর্থাৎ, ভবিষ্যতে সুদের হার আরও কমতে পারে।

স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া-র গ্রুপ চিফ ইকনমিক অ্যাডভাইসর। মতামত ব্যক্তিগত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন