স্মৃতি: তমলুকে টিমথির সমাধিস্থল। নিজস্ব চিত্র
দাঁড়াও পথিকবর’। মধুকবির মতো কোনও আহ্বান নেই সমাধি ফলকের লিপিতে। আসলে কোনও সমাধি ফলকই নেই। সমাধির আচ্ছাদনের উপরেই লেখা রয়েছে একেবারে ছিমছাম এপিটাফ। যে সমাধিলিপি পড়লে স্বামীর প্রতি এক স্ত্রীয়ের ভালবাসাই প্রকাশ পায়। কিন্তু যেটা বোঝা যায় না, সেটা হল, এক সদ্য বিবাহিত তরুণীর স্বামী হারানোর যন্ত্রণা। আর এক ব্রিটিশ অফিসারের অকাল মৃত্যু।
পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক শহর সংলগ্ন পায়রাটুঙ্গি খাল। সেই খালের কাছেই রয়েছে সেচ দফতরের কার্যালয় এবং বাংলো। বাংলো চত্বরে রয়েছে একটি ফুলের গাছ। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, এটি কাঠ কলকে ফুলের গাছ। সেই গাছের গোড়ায় ঝোপঝাড়ে ঢাকা। আগাছা সরিয়ে দেখার সাহস করলে একটা রেলিং চোখে পড়তে পারে। লোহার সেই ঘেরাটোপ আসলে ঘিরে রয়েছে একটি সমাধিস্থলকে। পাতা, পচা ফুলের নোংরা ঘষে মেজে দেখলে নজরে আসবে সমাধিলিপিটি। যাতে ইংরেজিতে লেখা, ‘আমার স্বামী টিমথি ফ্রান্সিস কুইনল্যানের প্রেমময় স্মৃতি’।
কে এই টিমথি ফ্রান্সিস? তমলুকের সেচ দফতরের বাংলো চত্বরে কেন তাঁকে সমাধি দেওয়া হয়েছে? সেই উত্তরের কিছুটা মিলবে সমাধিলিপি থেকেই। জানা যাবে, টিমথি ছিলেন ‘ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে’র এক অফিসার। বাড়ি আয়ারল্যান্ডের ব্যান্ডন শহরে। যিনি মাত্র ৩০ বছর বয়সে মারা যান। বাকি উত্তর খুঁজতে হবে ইতিহাস থেকে। ইতিহাস বলছে রূপনারায়ণ নদের তীরের তমলুক বা তৎকালীন তাম্রলিপ্ত শহরে বিদেশিদের আনাগোনা বহু শতাব্দী ধরে। সেই পথ ধরেই এসেছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৭৬০ সালে বাংলার নবাব মীরকাশিম কোম্পানির হাতে তিনটি জেলার দায়িত্ব তুলে দেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিল মেদিনীপুর। ভারত শাসনের জন্য এসেছিলেন ব্রিটেনের তরুণ প্রজন্ম। তাঁদেরই একজন টিমথি।
আয়ারল্যান্ডের অধিবাসী এই তরুণ অফিসার ‘ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস’ পাশ করে এসেছিলেন তমলুকে। তৎকালীন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার মহকুমা শহর ছিল তমলুক। রূপনারায়ণের ধারে শহরের পূর্বপ্রান্তে গড়ে তোলা হয়েছিল তমলুক মহকুমা প্রশাসনের সদর দফতর। মহকুমা শাসক ও মহকুমা আদলত চত্বরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে ব্রিটিশ স্থাপত্যের নিদর্শনধারী একাধিক ‘লালবাড়ি’। উত্তাল রূপনারায়ণের স্রোতের মতিগতি বোঝার জন্য এবং বিপদ সংকেত পেয়ে আগাম ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের সদর দফতর থেকে কয়েক’শ মিটার দূরেই শহরের পায়রাটুঙ্গির কাছে গড়ে তোলা হয়েছিল সেচ দফতরের অফিস ও বাংলো।
টিমথি তমলুকে কোন পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন জানা যায় না। সম্ভবত প্রশাসনিক উচ্চপদেই। কারণ এলাকার বিভিন্ন অভিজাত ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। তাঁকে নিমন্ত্রণও করা হত বিভিন্ন অভিজাত পরিবারে। তমলুককে কতটা ভালবেসে ছিলেন, জানা যায় না। কোনও লিখিত নথি নেই। তবে তমলুক তাঁর খারাপ লাগার কথা নয়। কারণ তাঁর জন্মভূমি আয়ারল্যান্ডের ব্যান্ডনের সঙ্গে বেশ মিল তমলুকের। ব্যান্ডন কর্ক কাউন্টিতে অবস্থিত। ব্যান্ডন নামে এক নদী তীরেরই তার অবস্থান। তবে তমলুকে বেশি দিন থাকা হয়নি তরুণ এই আইরিশ অফিসারের। অসুস্থতার কারণে আচমকাই তাঁর মৃত্যু হয়। দিনটা ১৯১৫ সালের ১৪ এপ্রিল। তখন টিমথির বয়স মাত্র ৩০ বছর। শোনা যায়, বছর খানেক আগে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। প্রায় নববধূ টিমথির স্ত্রী স্বামীকে সেচ দফতরের বাংলোর চত্বরে সমাহিত করে আয়ারল্যান্ডে ফিরে গেলেন। শ্বেতপাথরের সমাধিলিপিতে স্ত্রীর ভালবাসার কয়েকটি অক্ষর বুকে নিয়ে তমলুকে চিরকালীন হয়ে গেলেন টিমথি।
পায়রাটুঙ্গির সেচ বাংলোর প্রবেশ পথের ডান দিকে কাঠ কল্কে গাছের পাশেই টিমোথির সেই সমাধিক্ষেত্র রয়েছে। তমলুক শহর থেকে কোলাঘাটগামী রূপনারায়ণ নদের বাঁধের মাটির রাস্তা পাকা হয়েছে। ওই রাস্তার পাশেই পায়রাটুঙ্গি বাংলো ব্রিটিশ আমলেই তৈরি হয়েছিল। সেচ দফতরের ওই পরিদর্শন বাংলোর পুরনো ভবনেরই সংস্কার করে নতুন পাকা ভবন হয়েছে। নদীও সরে গিয়েছে কিছুটা। বাংলোর চত্বরে থাকা ওই সমাধিক্ষেত্র ঘিরে একসময় ফুলের বাগান তৈরি করে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হত। আর প্রাচীন এই শহরে আসা পর্যটক ও গবেষকদের কাছে দর্শনীয় স্থান ছিল ব্রিটিশ সাহেবের সমাধি। কিন্তু এক সময়ে আর কেউ নজর দেননি টিমথির সমাধির দিকে। তাঁর স্ত্রী ভালবাসার আখর অবহেলা ও অনাদরে ঢেকে যায় আগাছার ঝোপে।
আর এ নিয়ে ক্ষোভের সুর এলাকার বাসিন্দাদের। পায়রাটুঙ্গির সেচ বাংলোর পাশেই বাড়ি বলাই মান্নার। সত্তর ছুঁই ছুঁই বলাইবাবু বলেন, ‘‘ছোটবেলায় সেচ বাংলোর চত্বরে খেলাধুলো করেছি। ব্রিটিশ আমলে তৈরি সেচ বাংলোর ভবনটি আগে ছিল বোল্ডার ও চুন-সুরকি দিয়ে গাঁথা বাড়ি। বছর চল্লিশ আগে সেই বাড়ি সংস্কার করে নতুন পাকা ভবন হয়েছে। তবে এখানে ব্রিটিশ সাহেবের সমাধিক্ষেত্রটির সংরক্ষণে সরকার উদ্যোগী হয়নি। তমলুকের বুকে এই সমাধিক্ষেত্র রয়েছে
অনেকেই তা ভুলতে বসেছে। এটা খুবই আক্ষেপের।’’ বলাইবাবুর স্মৃতিতে উজ্জ্বল, সেচ বাংলোর আশেপাশে তেমন বাড়িঘর ছিল না। বাংলোর চত্বরে সমাধিক্ষেত্রের একদিকে কাঠ কলকে আর
একদিকে খেজুর গাছ ছিল। পাশেই বড় জলাশয় ছিল। ঝড়ে খেজুরগাছ ভেঙে গিয়েছে। তবে কাঠ কলকে গাছ এখনও মাথা উঁচু করে রয়েছে। সমাধিক্ষেত্র ঘিরে ফুলবাগান তৈরি করা ছিল। সারা বছর তা দেখাশোনার জন্য সেচ দফতরের নিযুক্ত তিনজন মালি ছিলেন। আর বাংলোয় ছিলেন একজন চৌকিদার।
তমলুকের ঐতিহ্যবাহী টিমথির সমাধিক্ষেত্র দেখতে এক সময় প্রচুর মানুষ আসতেন। কিন্তু ঠিক মতো সংরক্ষণের অভাবেই এটি অবেহলায় পড়ে রয়েছে। ঝোপজঙ্গলে ঢাকাই ছিল। ছবি তোলার জন্য তা পরিষ্কার করানো হয়। ব্রিটিশ সাহেবের সমাধিক্ষেত্রটি শহরের খ্রিস্টানদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। শহরের বাসিন্দা শুভ্রা দাসের কথায়, ‘‘প্রতি বছর বড়দিনে প্রভু জিশুর জন্মদিনে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। আমরা ছোটবেলায় পায়রাটুঙ্গির সেচ বাংলোয় সাহেবের সমাধিক্ষেত্রে গিয়ে মোমবাতি জ্বালাতাম। কিন্তু ওই সমাধিক্ষেত্রটি এখন অবেহলায় থাকায় খুবই খারাপ লাগে।’’
খারাপ লেগেছিল টিমথির স্ত্রীয়েরও। বিদেশ বিভুঁইয়ে স্বামীকে ছেড়ে জাহাজে উঠতে হয়েছিল সদ্য স্বামীহারা তরুণীকে!