প্রশাসকের দায়িত্ব

কিন্তু প্রশাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? সেই ভূমিকায় তাঁহার যথার্থ সাফল্য এখনও দূর অস্ত্।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:১৫
Share:

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক জীবনের ইতিবৃত্তে আন্দোলন এবং জনসংযোগের গুরুত্ব বরাবর অপরিসীম। ‘লড়াকু নেত্রী’র আদি অভিধাটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনও ম্লান হইতে দেন নাই। এমনকি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হইয়াও নয়। ২০১১ সালের পরে তাঁহার আচরণে কিছু পরিমার্জন ঘটিয়াছে, কিন্তু আপন স্বাভাবিক রাজনীতি তিনি পরিত্যাগ করেন নাই। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি ও আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রকরণ হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী বারংবার আন্দোলনের পথে নামিয়াছেন। পথ চলিবার অভ্যাসই তাঁহার জনসংযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাধন। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং প্রস্তাবিত জাতীয় নাগরিক পঞ্জির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইতে মহানগরীর বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁহার পদযাত্রা সেই ধারার অনুসারী। সঙ্ঘ পরিবারের শাসকরা নাগরিক বাছাইয়ের নামে বিদ্বেষমূলক বিভেদের রাজনীতিকে যে ভাবে ব্যবহার করিতেছেন, তাহার বিপজ্জনক ও অনৈতিক রূপটিকে জনসমক্ষে উন্মোচনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর প্রচার অভিযান অব্যাহত। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি তিনি নাগরিক বাছাইয়ের বিষয়ে যে তীক্ষ্ণ প্রশ্নগুলি ছুড়িয়া দিয়াছেন, মোদী-শাহ তাহার উত্তর দিবেন বলিয়া মুখ্যমন্ত্রীও নিশ্চয়ই আশা করেন না, তাঁহার প্রকৃত লক্ষ্য: জনসাধারণের মনে ওই প্রশ্নগুলি জাগাইয়া তোলা। গণতন্ত্রে সেই কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সফল এবং সার্থক বলিবার যথেষ্ট কারণ আছে।

Advertisement

কিন্তু প্রশাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? সেই ভূমিকায় তাঁহার যথার্থ সাফল্য এখনও দূর অস্ত্। নাগরিকত্ব আইনের প্রশ্নে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে যে ব্যাপক অশান্তি এবং হিংসার বিস্ফোরণ ঘটিয়াছে, প্রতিবাদের নামে দুষ্কৃতীদের যে ভাবে তাণ্ডব করিতে দেওয়া হইয়াছে, তাহা রাজ্য প্রশাসনের লজ্জাকর এবং উদ্বেগজনক ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। ব্যাপক উপদ্রব সত্ত্বেও দুষ্কৃতীদের চিহ্নিত করিয়া গ্রেফতার করিতে যে প্রশাসনের বাহাত্তর ঘণ্টা লাগে, তাহাকে আর যাহাই হউক, প্র(কৃষ্ট)শাসন বলা চলে না। নাগরিকেরা ভুলিবেন না যে, প্রথম দুই দিনে পুলিশ চোখের সামনে তাণ্ডবের দৃশ্যাবলি দেখিয়াও কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল এবং সমালোচনার জবাবে নিবেদন করিয়াছিল যে, তাহাদের হাতে— দ্বিতীয় দিনেও— যথেষ্ট বাহিনী ছিল না। পুলিশের কর্তারা সাফাই গাহিয়াছেন: প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করিয়া তবেই তাঁহারা গুন্ডা ধরিতে নামিয়াছেন। রসিকতা হিসাবেও এই অজুহাত অতীব নিম্নমানের। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকেরা নির্বোধ নহেন। পুলিশ কখন সচল হয় এবং কেন অচল থাকে, তাঁহাদের অজানা নহে। অনেক দেখিয়া এবং ঠেকিয়া তাঁহারা সার সত্য শিখিয়াছেন। সত্যের দুই দিক। এক, পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন বহু কাল আগেই, সিপিআইএমের সৌজন্যে, রাজধর্ম হইতে বিচ্যুত; দুই, তৃণমূল কংগ্রেসের অনুপ্রেরণায় সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে।

মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁহার প্রশাসনের অভিযোগ, সাম্প্রতিক উপদ্রবের পিছনে গভীর চক্রান্ত আছে। এই অভিযোগ উড়াইয়া দিবার উপায় নাই। সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি সহস্র ফণা মেলিয়াছে, চক্রান্ত না থাকিলেই অবাক হইতে হইবে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টির চক্রান্ত। জনজীবন বিপর্যস্ত করিবার চক্রান্ত। রাজনৈতিক মেরুকরণের চক্রান্ত। বিধ্বংসী দুরভিসন্ধির সাক্ষ্যপ্রমাণও মিলিতেছে, নরেন্দ্র মোদীর ভাষায় যে ‘পোশাক দেখিলেই চিনিয়া লওয়া যায়’ সেই পোশাক পরিয়া ট্রেনের ইঞ্জিনে ঢিল ছুড়িতে গিয়া বুধবার মুর্শিদাবাদে কে বা কাহারা ধরা পড়িয়াছে, যে মুর্শিদাবাদ সাম্প্রতিক অশান্তির অন্যতম কেন্দ্র ছিল। চক্রান্ত সম্পর্কে নাগরিকদের সতর্ক থাকিতে হইবে, মুখ্যমন্ত্রীর এই চেতাবনির গুরুত্ব প্রশ্নাতীত। কিন্তু সেই কারণেই প্রশাসনের প্র-শাসন হইয়া উঠিবার প্রয়োজনও এখন অস্বাভাবিক রকমের বেশি।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন