দিব্যি: জঙ্গলমহল সফরে গিয়ে হঠাৎ গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। গোপীনাথপুর, ঝাড়গ্রাম। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩
বালিগঞ্জ লেকের এক বিরল কোণে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। একা। সামনে রাখা ঝালমুড়ির ঠেলাগাড়ি। ওটাই তাঁর পসরা। জীবনযুদ্ধের হাতিয়ারও। নজরুল মঞ্চে একটি অনুষ্ঠান সেরে লেকের ভিতরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখ পড়েছিল আলোর পিছনে থাকা শীর্ণকায় চেহারাটির দিকে। তাঁর সঙ্গে আরও যাঁরা হাঁটছিলেন, তাঁদের কারও কিন্তু কোনও ভ্রূক্ষেপ ছিল না। অনায়াসে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সবাই। মুখ্যমন্ত্রীকে থামতে দেখে সঙ্গীরা পিছু ফিরলেন। তিনি ততক্ষণে চলে গিয়েছেন বৃদ্ধ লোকটির কাছে। পরম মমতায় জানতে চাইছেন, ‘কী হয়েছে আপনার? এখানে একা দাঁড়িয়ে কেন? বিক্রি হয়নি?’ কথোপকথনে জানা গেল, অসুস্থ ভদ্রলোক থাকেন বালিগঞ্জ স্টেশন লাগোয়া বস্তিতে। ভাল করে চলতে পারেন না। তবু একমাত্র ছেলের মৃত্যুর পরে সংসারের দায় সামলাতে ঝালমুড়ির গাড়ি ঠেলে রোজ তাঁকেই বেরোতে হয়। যে দিন যেটুকু বিক্রি হয়, সেটুকুই সম্বল। তাই দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর ভরণপোষণ চলে। কথা বলতে বলতেই ব্যাগ খুলে কিছু টাকা লোকটির হাতে তুলে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বললেন, ‘সাবধানে বাড়ি চলে যান।’
ক’দিন আগের এ কাহিনি এখানেই শেষ হতে পারত। তাতে হয়তো কোনও নতুন মাত্রাও যোগ হতো না। লোকে বলতেন, এ রকম তো কতই হয়! কিন্তু তা হয়নি। কারণ মমতা সেখানে থামেননি। সে দিন বাড়ি ফিরে গভীর রাত পর্যন্ত খোঁজখবর করেছেন লোকটির পরিবারে এমন কেউ আছেন কি না, যাঁকে চাকরি দিলে পরিবারটির খাওয়া-পরার ব্যবস্থা হতে পারে। পরিবারটির চিকিৎসার খরচ ও কিছু সহায়তার জন্য দরকারি নির্দেশও দিয়েছেন দলের সহকর্মীদের। আর সবটাই হয়েছে নীরবে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, এত সাতকাহন করে এ কথা জানানোর কী প্রয়োজন? আমি মনে করি, দরকার আছে। কারণ দেশ এখন এখন বিচিত্র পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। এখন দলিতদের সঙ্গে বড় বড় নেতার বৈঠক বা কোনও গরিব, আদিবাসীর বাড়িতে ভাত খেতে বসা নিয়ে ঢালাও প্রচার করা হয়। মিডিয়ার ক্যামেরা হামলে পড়ে নেতাদের মুখের ওপর। বোঝানো হয়, অমুক নেতা-তমুক মুখ্যমন্ত্রী কত গরিবদরদি, কত দলিত-প্রেমী! অথচ সেই সব প্রেমের আড়ালে কী নির্মম নাটকের উপাদান মজুদ থাকে তা অনেকেরই নজরে পড়ে না। মমতা সেখানে অবশ্যই ব্যতিক্রমী। সেটাই বা অজানা থাকবে কেন?
আরও পড়ুন: দলাদলি চলবে না, কড়া বার্তা মমতার
উত্তরপ্রদেশের সংসারত্যাগী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এখন মোদীর ভারতে শো-কেসের অন্যতম মুখ। তাঁর পর পর দুটি কর্মসূচির খবর প্রকাশ্যে এসেছে। একটি, এক আদিবাসী পরিবারে মধ্যাহ্নভোজ। অন্যটি দলিতদের সঙ্গে বৈঠক। খবরে প্রকাশ, আদিত্যনাথ যে পরিবারে গিয়েছিলেন, সেখানে তিনি যাওয়ার আগে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এয়াককন্ডিশনিং মেশিন বসানো হয়েছিল পাছে গরমে যোগীর কষ্ট হয়। আর মুখ্যমন্ত্রী দু-দশ মিনিট দেখা করে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই মেশিন খুলে নেওয়া হয়। হা-ঘরে আদিবাসীরা ঠান্ডা হাওয়া খাবে! তা হয় না কি? একই মানসিকতায় আদিত্যনাথ দেখা করবেন বলে সেই দলিত প্রতিনিধিদের হাতে আগেভাগে সাবান-শ্যাম্পু-তেল-সুগন্ধি পৌঁছে দিয়ে বলে দেওয়া হয়েছিল, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আসতে হলে নেয়ে-ধুয়ে সাফসুতরো হয়ে গায়ে সুগন্ধি ছড়িয়ে আসতে হবে। কারণ ‘নোংরা’ দলিতদের যোগী সইতে পারেন না! কিছুদিন আগেই এই রাজ্যে এসে আদিবাসীদের বাড়িতে পাত পেড়েছিলেন বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। আগাম আয়োজনে ভোজের ‘মঞ্চ’ কীভাবে সাজানো হয়েছিল, সেটাও অনুমান করার অপেক্ষা রাখে না।
এটা ঠিক, পেশাদার রাজনীতিকদের অনেক সময় নানারকম ভেক ধরতে হয়। কখনও তা সূক্ষ্ম, কখনও মোটা দাগের। কিন্তু ভেকটাই আড়ম্বর হয়ে উঠলে সেই রাজনীতিকদের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এই পশ্চিমবঙ্গেই এমন নেতা দেখেছি, যিনি এক পকেটে মন্দিরের জবা ফুল, অন্য পকেটে মসজিদের আশীর্বাদী কাপড় নিয়ে প্রচারে বেরোতেন। যেখানে যেমন, সেখানে তেমন। কলকাতার এক নামী ব্যক্তি কোনও একটি জেলায় কংগ্রেসের প্রার্থী হতেন। তিনি গায়ে চড়া সুগন্ধী না মেখে গ্রামে যেতে পারতেন না। আর এক প্রার্থী কোর্ট থেকে স্যুট-বুট পরে ফিরে প্রচারে বেরোনোর জন্য পরিচারককে ডেকে বলতেন, ‘আমার সভায় যাওয়ার স্যুটটা দাও।’ পরিচারক খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি-চাদর এগিয়ে দিতেন।
মমতাকে যাঁরা ঘনিষ্ঠভাবে চেনে, তাঁরা জানেন তিনি ঠিক এই গোত্রে পড়েন না। তাঁর আবেগের আতিশয্যকে কেউ কটাক্ষ করতেই পারেন। কিন্তু তাঁর আন্তরিকতায় খাদ কম। সাজানো মঞ্চে আবেগ দেখানোর নাটকও তাঁর ধাতে নেই। দু-একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। পশ্চিম মেদিনীপুরের শিলদায় সভা সেরে ঝাড়গ্রাম যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। হঠাৎ ইচ্ছে হল, রাস্তার ধারে কোনও একটি বাড়িতে ঢুকবেন। সরকারি প্রকল্পের কতটা সুযোগ প্রাপকের হাতে পৌঁছচ্ছে, সরসরি তার খোঁজ নেবেন। চালককে বললেন, ‘ওই যে আলো জ্বলছে, ওখানে থামব।’ যে বাড়িতে নামলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে চিনে উঠতেই তাঁদের দু’মিনিট লাগল। তাঁরা বুঝবেন কী করে, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী দরজায়! প্রশাসনের অন্য কর্তারা গাড়ি ঘুরিয়ে আসতে আসতে মমতা বসে পড়েছেন সেই বাড়ির উঠোনে। নড়বড়ে চেয়ার একটিই ছিল। বসেই বললেন, ‘আমি কিন্তু চা খাব। মুড়ি আছে?’ এর পরের কথাগুলি এখানে অপ্রাসঙ্গিক। শুধু এটুকুই বলার, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ওই কুটিরে কোনও আগাম নাটকীয় ঘোষণা ছাড়াই বসে চা খেয়েছিলেন। তাঁর জন্য মিনারেল ওয়াটার বা এয়ারকন্ডিশনারের ব্যবস্থাও করতে হয়নি। দার্জিলিঙে এক প্রশাসনিক কর্তার বাংলোয় চায়ের নিমন্ত্রণে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বাড়ির কাজের লোকেদের থাকার জায়গা এবং বাথরুম দেখতে গিয়েছিলেন। তার জন্যও কোনও চিত্রনাট্য তৈরি ছিল না।
আজ দলিত, আদিবাসী, পিছড়ে বর্গকে জড়িয়ে ধরার যে প্রতিযোগিতা চলছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই মমতা হয়তো এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ। নরেন্দ্র মোদীর সরকারের বর্ষপূর্তি পালনের ঘটাকে খোঁচা দিয়ে সে দিন তিনি বলেছেন, ‘আমাদের ঝুনঝুনি বাজিয়ে বলতে হয় না।’ প্রেক্ষিত ভিন্ন হলেও কথাটা একেবারে অমূলক নয়। ঝুনঝুনি বাজিয়ে বলেন যাঁরা তাঁদের জন্য সাবান-সেন্ট-এয়ার কন্ডিশনের আগাম জোগান রাখতে হয়। মমতা সটান ঘরে ঢুকে হাঁক দেন, ‘একটু চা খাওয়ান’।