লটারির বিপদ

লটারি চালু রাখিবার পক্ষেও এক ধরনের যুক্তি থাকিতে পারে। লটারিই একমাত্র বস্তু, যাহা হতদরিদ্র মানুষকেও ধনী করিতে পারে। হইতে পারে, লটারিতে জিতিবার সম্ভাবনা যৎসামান্য। কিন্তু কোটি কোটি স্বল্পবিত্ত মানুষের নিকট স্বপ্ন সত্য হইবার সম্ভাবনা ওইটুকুই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

তামাক কিংবা মদের ন্যায়, লটারির টিকিটকে ‘নেশাদ্রব্য’ বলিয়া গণ্য করা হয় না। কিন্তু লটারি খেলিবার নেশায় অগণিত পরিবার সর্বস্বান্ত হইতেছে। পরিবারকে বঞ্চিত করিয়া আয়ের সিংহভাগ লটারিতে ব্যয় করিতেছেন অগণিত মানুষ। অনেকে গৃহ এবং অন্যান্য সম্পত্তি বাঁধা রাখিয়াও ক্রমাগত টিকিট কিনিয়া চলিতেছেন। এই আবর্ত হইতে বাহির হওয়া অনেকের পক্ষেই মদ কিংবা মাদকের আকর্ষণ উপেক্ষা করিবার মতোই দুঃসাধ্য। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় আত্মহত্যা করিয়াছেন, এমন মানুষ কম নাই। এমনকি যাঁহারা জিতিয়াছেন, তাঁহারাও সকলে ধনী হইবার স্বপ্নকে স্পর্শ করিতে পারেন নাই। অল্প সময়ে সব টাকা হারাইয়া আবার দরিদ্র জীবনে ফিরিয়া গিয়াছেন, এমন বিবরণ সংবাদে প্রকাশিত হইয়াছে। বৎসরের পর বৎসর লটারির টিকিট কিনিয়াও বিফল, ঋণগ্রস্ত, হতাশ হইয়াছেন, এমন দৃষ্টান্ত অজস্র। কিন্তু লটারির টিকিটের বিক্রয় কমে নাই। সংবাদে প্রকাশ, এক একটি মহকুমায় দিনে এক কোটি টাকার টিকিট বিক্রয় হইতেছে। ২০১৫ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক লটারি নিষিদ্ধ করিবার প্রস্তাব পেশ করে রাজ্য সভায়। তাহাতে বলা হয়, ভারতে বৎসরে অন্তত পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকার লটারির টিকিট বিক্রয় হয়, এবং দৈনিক অন্তত দুই কোটি মানুষ টিকিট ক্রয় করেন। যে সব দেশে লটারি আইনত বৈধ, তাহার প্রায় সর্বত্র এই বিপুল ব্যয়ের চিত্র মেলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় অর্ধেক নাগরিক প্রতি বৎসর অন্তত একবার লটারির টিকিট কিনিয়া থাকেন। সেই দেশে লটারির জন্য নাগরিকের ব্যয় শিক্ষা, খেলা এবং বিনোদনের সামগ্রিক ব্যয়ের চাইতে অধিক।

Advertisement

লটারি চালু রাখিবার পক্ষেও এক ধরনের যুক্তি থাকিতে পারে। লটারিই একমাত্র বস্তু, যাহা হতদরিদ্র মানুষকেও ধনী করিতে পারে। হইতে পারে, লটারিতে জিতিবার সম্ভাবনা যৎসামান্য। কিন্তু কোটি কোটি স্বল্পবিত্ত মানুষের নিকট স্বপ্ন সত্য হইবার সম্ভাবনা ওইটুকুই। তাহার অধিক নহে। সেই সুযোগ কাড়িয়া লইবার অধিকার কি অপর কাহারও আছে? কিন্তু এই যুক্তি প্রকৃতপ্রস্তাবে একটি বিপজ্জনক নেশা চালু রাখিবার পক্ষে অজুহাতমাত্র। বাস্তব কুফলগুলি বিচার করিলে মানিতেই হইবে, লটারির এই বিপুল জনপ্রিয়তা এক নৈতিক সঙ্কটে ফেলিয়াছে সমাজ তথা রাষ্ট্রকে। নাগরিকের সুরক্ষা রাষ্ট্রের কর্তব্য। অন্যান্য মাদকের ন্যায় লটারিও নাগরিকের এক বৃহৎ অংশকে বিপথচালিত করে, তাহার অর্থের অপচয় ও চরিত্রের অপকর্ষ ঘটাইয়া থাকে, সে সম্পর্কে সাক্ষ্যপ্রমাণ রহিয়াছে। তাহা হইলে রাষ্ট্র লটারি নিষিদ্ধ করিবে না কেন? বস্তুত, ভারতে তেরোটি রাজ্য ব্যতীত বাকি সবগুলিতে লটারি নিষিদ্ধ। সারা ভারতে অনলাইন লটারি নিষিদ্ধ করিয়াছে কেন্দ্র।

কোষাগারের চালকরা অবশ্য বলিবেন, লটারি হইতে যে বিপুল রাজস্ব মেলে, রাজকোষের জন্য তাহার প্রয়োজন। তাহার ব্যয় হইবে উন্নয়নে। এই যুক্তি অনৈতিক। উন্নয়ন নাগরিকের জন্য, তাহাকে বিপন্ন করিয়া উন্নয়নের জন্য অর্থসংগ্রহ করা চলে না। আর অধিক রাজস্ব পাইবার তাড়নায় যদি ক্রমাগত মদ কিংবা লটারির বিক্রয় বাড়াইতে থাকে সরকার, তাহার পরিণাম হইবে ভয়ানক। অতএব সংযত হউক সরকার। বরং মাদক কিংবা মদের অপকারিতার ন্যায়, লটারির নেশার বিপদ সম্পর্কে প্রচারের ব্যবস্থা প্রয়োজন। তাহাও সরকারেরই কর্তব্য।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন