এমন ‘গেল গেল’ রব কেন

কেন্দ্রীয় সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের নির্দেশ অনুযায়ী বি এড ডিগ্রি ব্যতীত কাউকেই শিক্ষক পদে নিয়োগ করা যায় না। অতএব কোনও রকম প্রশিক্ষণহীন শুধুমাত্র স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ছেলেমেয়েদের এ ভাবে পড়ানোর কাজে নিযুক্ত করা যায় কি না, প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।

Advertisement

সীমান্ত গুহঠাকুরতা

শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

প্রায় সাত-আট বছর এ রাজ্যে সরকার অনুমোদিত স্কুলগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল। সম্প্রতি কিছু নিয়োগ হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা নেহাতই সামান্য। পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে শিকেয় উঠেছে পঠনপাঠন। সম্প্রতি উত্তর দিনাজপুরের দাড়িভিট স্কুলের হাঙ্গামা আর সাগরের মৃত্যুঞ্জয়নগর বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকাকে ‘রিলিজ়’ না দিতে চাওয়া নিয়ে হাইকোর্টে মামলা, এই দু’টি ঘটনা শিক্ষকের অভাবে রাজ্যের স্কুলগুলোর দৈন্যদশাকে একেবারে বেআব্রু করে দিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে অতঃপর ঘোষণা: স্থানীয় শিক্ষিত যুবকযুবতীদের মধ্যে থেকে চুক্তিভিত্তিক ‘ইন্টার্ন’ শিক্ষক নিয়োগ করা হবে স্কুলগুলোতে, মাসিক দু’হাজার টাকা বেতনের বিনিময়ে। সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে আপাতত তোলপাড় রাজ্যের শিক্ষাজগৎ। বিরোধীরা পথে নেমেছেন, তীব্র নিন্দায় মুখর হয়েছে শিক্ষক-সংগঠনগুলি, ট্রেনে-বাসে আমজনতাও ছিছিক্কারে ভরিয়ে দিচ্ছে সরকারকে। এতই তীব্র সেই সমালোচনার ধার যে, সিভিক পুলিশের অনুকরণে হবু সেই ‘ইন্টার্ন’ শিক্ষকদের নামই দেওয়া হয়ে গিয়েছে ‘সিভিক টিচার’।

Advertisement

কেন্দ্রীয় সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের নির্দেশ অনুযায়ী বি এড ডিগ্রি ব্যতীত কাউকেই শিক্ষক পদে নিয়োগ করা যায় না। অতএব কোনও রকম প্রশিক্ষণহীন শুধুমাত্র স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ছেলেমেয়েদের এ ভাবে পড়ানোর কাজে নিযুক্ত করা যায় কি না, প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। এমন নয় যে এ রাজ্যের সরকার অনুমোদিত স্কুলগুলিতে যাঁরা শিক্ষকতার ‘চাকরি’ করেন, তাঁরা ‘প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত’ নন। তাঁরা প্রায় সকলেই বি এড করেছেন, কেউ সম্প্রতি, কেউ বা কুড়ি বছর আগে। কিন্তু সত্যিটা হল এই যে, তাঁদের কেউই পরবর্তী কালে সেই প্রশিক্ষণের কিচ্ছুটি মনে রাখেননি বা রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি।

রাজ্যের যে কোনও সরকারপোষিত স্কুলের যে কোনও একটি ক্লাসে ঢুঁ মারলে দেখা যাবে, ম্যাপ-চার্ট-মডেল-গ্লোব ইত্যাকার কোনও শিক্ষা-সহায়ক উপকরণের বালাই সেখানে নেই, যাবতীয় প্রশিক্ষণকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে শিক্ষকশিক্ষিকারা সেই আদ্যিকালের ‘লেকচার মেথড’-এ পঠনপাঠন চালিয়ে যাচ্ছেন। চক ডাস্টারটিও ব্যবহার হয় কালেভদ্রে। শিক্ষাবিজ্ঞান কয়েক হাজার মাইল এগিয়ে গিয়েছে, শিক্ষাদান ও শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় যুগান্তর ঘটে গিয়েছে, কিন্তু এ রাজ্যের অধিকাংশ স্কুলশিক্ষক এখনও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, বি এড হল শিক্ষকতার চাকরি পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় এক আলঙ্কারিক ডিগ্রি মাত্র, পঠনপাঠনে যার কোনও উপযোগিতা নেই।

Advertisement

খাতায়-কলমে এই তো হল ‘প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত’ বনাম ‘প্রশিক্ষণবিহীন’ শিক্ষকের পার্থক্য। এ নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই ভাল। বি এড ডিগ্রি কত টাকার বিনিময়ে কোথায় কোথায় পাওয়া যায়, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এত বি এড কলেজ কী ভাবে গজিয়ে উঠছে, তাদের পরিকাঠামোই বা কোন স্তরের, সে সব প্রশ্নের এখন দরকার নেই।

বেশি দরকারি, চাকরিটা সরকারি না বেসরকারি সেই প্রশ্নটি। ট্রেনে-বাসে-সোশ্যাল মিডিয়ায় যত আলোচনা শুনছি, তার সর্বত্রই গুরুত্ব পাচ্ছে ‘সরকারি’ শিক্ষক নিয়োগে সরকারের অনীহা এবং তার বদলে শিক্ষকপিছু মাসিক মাত্র দু’হাজার টাকায় কাজ চালানোর প্রসঙ্গটি। ‘শিক্ষার মান’ এতে বাড়বে না কমবে, তা নিয়ে কেউই খুব একটা ভাবিত নন। যেন আমরা স্বতঃসিদ্ধ ভাবেই ধরে নিয়েছি যে এক জন মোটা মাইনের সরকারি শিক্ষক মানেই তিনি ভাল পড়াবেন। আর যে ছেলেটি বা মেয়েটি খুব অল্প টাকায় চুক্তিভিত্তিক শ্রমদানে নিযুক্ত হয়েছেন, তাঁর কাজের গুণমান কিছুতেই ভাল হতে পারে না।

অথচ ঘটে কিন্তু তার উল্টোটাই। বড় রাস্তার মোড়ে দেখবেন, রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাথায় ট্রাফিক সামলাচ্ছেন সিভিক ভলান্টিয়ার আর অদূরে পেট্রল ভ্যানে বসে চা খেতে খেতে মোবাইল ঘাঁটছেন পুলিশ অফিসার। অপ্রিয় হলেও সত্যি এটাই যে, গ্রাম হোক বা শহর, এ রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাকেও একই ভাবে ধরে রেখেছেন ওই বিষয়পিছু এবং মাথাপিছু তিনশো বা চারশো টাকা বেতনের প্রাইভেট মাস্টাররাই, যাঁদের অধিকাংশই শিক্ষিত বেকার যুবকযুবতী। অভিভাবকরাও এখন স্কুল-মাস্টারদের থেকে এঁদের ওপরেই ভরসা রাখছেন অনেক বেশি। স্কুলে তো শুধু নামটা নথিভুক্ত রাখতে হয়, সময়মতো পরীক্ষাগুলো দেওয়ার জন্য। প্রতি বছরই মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিকে খুব ভাল ফলাফল করেছে এমন ছাত্র বা ছাত্রীদের নিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখবেন, প্রায় সকলেরই প্রতিটি বিষয়ে এক বা একাধিক ‘প্রাইভেট’ মাস্টার থাকেন। মানব-সম্পদ উন্নয়নে এই তো ভূমিকা সরকারি শিক্ষকদের!

বাম জমানার একেবারে প্রথম দিকে এ রাজ্যের স্কুলগুলোর শিক্ষকদের চাকরি পাকা হয়, শেষ পর্বে এসে তৈরি হয় স্কুল সার্ভিস কমিশন এবং এক এক লপ্তে প্রচুর শিক্ষক নিয়োগ শুরু হয়। এই সমস্ত ‘সদর্থক’ কাজের ফলে আমাদের সমাজ পেয়েছে প্রচুর পয়সাওয়ালা একটা বিরাট মধ্যবিত্ত শ্রেণি। রূঢ় শোনালেও এটাই কিন্তু সত্যি যে, এ রাজ্যে এই মুহূর্তে সর্বোত্তম পরিকাঠামো-যুক্ত একটি বেসরকারি স্কুল চালাতে মাসে মোট যত খরচ হয়, যে কোনও একটি সরকার অনুমোদিত স্কুলে শুধুমাত্র শিক্ষকদের বেতন দিতেই খরচ হয় তার থেকে অনেক বেশি টাকা। জনগণের টাকার সেই বিপুল ব্যয়ের বিনিময়ে এ রাজ্যের শিক্ষার মান কতটা বাড়ছে, তা নিয়ে কিন্তু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার রিপোর্টে গুরুতর সব প্রশ্ন উঠে আসে।

সরকারি চাকরির ‘নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা’ এবং পরিদর্শক কর্তৃপক্ষের তরফে ‘নজরদারির ঢিলেমি’ সামগ্রিক ভাবে পঠনপাঠনকে কতটা প্রভাবিত করেছে, প্রশ্ন উঠবে তা নিয়েও। শিক্ষকশিক্ষিকাদের বেতনের অঙ্কটা অবশ্যই সম্মানজনক হওয়া উচিত এবং দু’হাজার টাকা সে তুলনায় যে নেহাতই কম, তা-ও অনস্বীকার্য। কিন্তু শিক্ষকতার চাকরিটি ‘সরকারি’ হলেই যদি শিক্ষার মান বাড়ত, তা হলে বাম আমলে রাজ্যের শিক্ষার অগ্রগতির সূচক আকাশ ছুঁয়ে ফেলতে পারত। হয়েছে উল্টোটাই।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক শিক্ষাবিদের বক্তব্য শোনার সু্যোগ হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে, শিক্ষকদের একটি সর্বভারতীয় উজ্জীবনী কর্মশালায়। তিক্ত স্বরে সে দিন তিনি বলছিলেন, ‘‘কাজ করুন মাস্টারমশাইরা, পেশাদার হন। আপডেট করুন নিজেদের। জেনে রাখবেন, যা মাইনে আপনি পান, তার এক চতুর্থাংশের বিনিময়ে আপনার থেকে অনেক ভাল ভাবে কাজটা করে দেওয়ার জন্য কয়েক হাজার ছেলেমেয়ে বাইরে বসে আছেন। চাকরিটা সরকারি না বেসরকারি, তা নিয়ে মাথা ঘামাবার মতো অবস্থাও তাঁদের নেই।’’

‘ইন্টার্ন’-শিক্ষক নিয়োগের সাম্প্রতিক সরকারি সিদ্ধান্তের কথা শুনে কেন জানি না সেই কথাগুলো মনে পড়ে গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন