হ্যাঁ, স্বামীরাও ধর্ষণ করে থাকে

আমাদের সমাজে বেশির ভাগ মেয়েকে ছোটবড় নানা সিদ্ধান্ত এখনও নিতে হয় কোনও না কোনও পুরুষের মতানুসারে। এহেন পরিস্থিতিতে যৌন সম্পর্কে স্ত্রীর সম্মতির মূল্য দেওয়ার শিক্ষা বেশির ভাগ স্বামীরই থাকে না।

Advertisement

দোলন গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৬:১০
Share:

জয়াকে আমি দেখেছিলাম বছর বিশেক আগে। জয়া তখন মধ্য চল্লিশ, টালিগঞ্জের কাছে একটি মধ্যবিত্ত পাড়ায় ওদের বাড়ি। স্বামী বেসরকারি সংস্থার বড় চাকুরে। দুই স্কুলপড়ুয়া সন্তানের মা জয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, স্বামী তাঁকে যখন তখন জোর করে বিছানায় নিয়ে যায়। দিনের বেলা, রাতের বেলা, যখন তখন। এমনকী ছেলেমেয়ের সামনেই দিনদুপুরে শোওয়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়।

Advertisement

মনে পড়ল মিতার কথা। যার স্বামী নিজে শারীরিক সংগমে ক্লান্ত হয়ে পড়লে মিতার যোনিতে বেগুন, ঢ্যাঁড়স প্রবেশ করিয়ে রতিসুখ অনুভব করত। আর দক্ষিণ ২৪ পরগনার সামিনাদি? গ্রামের মেয়েদের নিয়ে ওয়ার্কশপে সারা দিনের কাজের তালিকা প্রস্তুত করতে বলা হয়েছিল। সামিনাদি কাজের তালিকায় রেখেছিলেন, স্বামীর ইচ্ছেমত তাকে যৌনকাজে সঙ্গ দেওয়া।

অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, এ দেশের মেয়েরা স্বামীর দ্বারা প্রায়শই ধর্ষিত হন। বিবাহিত সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণ বেশ প্রচলিত একটি নির্যাতন এ দেশে। নির্ভয়া কাণ্ডের পর ধর্ষণের আইন সংশোধনের জন্য ২০১৩ সালে সরকার নিয়োজিত বিচারপতি বর্মা কমিটির সুপারিশেও স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে বিয়ে অথবা নারী-পুরুষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কখনওই বিচারের ভিত্তি হতে পারে না, যৌনসম্পর্কে স্ত্রী অথবা বান্ধবীর সম্মতি না থাকলে, ইচ্ছে না থাকলে, তা ধর্ষণ হিসেবে গ্রাহ্য করা উচিত।

Advertisement

আমাদের সমাজে বেশির ভাগ মেয়েকে ছোটবড় নানা সিদ্ধান্ত এখনও নিতে হয় কোনও না কোনও পুরুষের মতানুসারে। এহেন পরিস্থিতিতে যৌন সম্পর্কে স্ত্রীর সম্মতির মূল্য দেওয়ার শিক্ষা বেশির ভাগ স্বামীরই থাকে না। আমাদের সংস্কৃতিতে ছেলেদের শেখানো হয়, বিয়ে করা বউ হল তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তার শ্রম, সম্পদ, শরীরের ওপর স্বামীর নিঃশর্ত দখলদারিরই আর এক নাম বিয়ে।

আমাদের রাষ্ট্রেরও সেই মত। তাই বর্মা কমিটির সুপারিশ সত্ত্বেও বৈবাহিক সম্পর্কের ভিতর যৌনাচারের ক্ষেত্রে স্ত্রীর সম্মতির ধারণাটি সরকার বারংবার নাকচ করে দেয়। সরকার স্পষ্ট করেই বলেছে যে, বিয়ের মধ্যে ধর্ষণকে স্বীকৃতি দিলে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করা হয়। তার মানে এই দাঁড়ায় যে, বিয়ের মধ্যে যৌন নির্যাতন স্ত্রীদের মেনে নিতে হবে। আমাদের রাষ্ট্র কয়েক দশক আগে পর্যন্ত স্বামীর মারধরকে অত্যাচার হিসেবে আমল দিতে রাজি ছিল না। যৌননির্যাতন যে একটি সম্পর্ক-নিরপেক্ষ ব্যাপার, এ অত্যাচার অপরিচিতের দ্বারা ঘটলে যতটা অপরাধ, স্বামীর দ্বারা ঘটলেও ততখানিই অন্যায়, ন্যায়ের এই বোধটি আমাদের সরকারের এখনও হয়নি, অথবা এ হল পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ইচ্ছাকৃত ভড়ং।

সরকারের দ্বিতীয় যুক্তিটি হল, স্বামী-স্ত্রীর শোওয়ার ঘরে তো কোনও সাক্ষী থাকে না, তা হলে স্ত্রী যদি মিথ্যে কথা বলে, তখন কী হবে? অথচ মথুরা ধর্ষণ মামলার পর ১৯৮৩ সালে আইনে যে রদবদল হল, তাতে বলা হয়েছে, ধর্ষণ প্রমাণের দায় ধর্ষিতার নয়। অভিযুক্তকে প্রমাণ করতে হবে সে নির্দোষ। আইনে আরও বলা হয়েছে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে অভিযোগকারিণীর কথা বিশ্বাস করেই আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। যদি অচেনা লোক নির্যাতন করলে আইন নির্যাতিতাকে বিশ্বাস করতে পারে, তা হলে অভিযুক্ত ক্ষেত্রে নির্যাতিতা মহিলাকে বিশ্বাসে অসুবিধা কোথায়?

আসলে আমাদের রাষ্ট্র ভারী ভয় পেয়েছে। যদি বিয়েগুলো পটাপট পাটকাঠির মতো ভেঙে যেতে থাকে, তা হলে কী হবে? বিয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পরিবারগুলির কী হবে? কে পরিবারে বিনে মাইনেয় গাধার খাটুনি খাটবে? কে বাড়ির আহ্লাদি বাবুসোনাটির অফিসের আগে তার মুখের কাছে বাড়া ভাত, ইস্ত্রি করা জামা গুছিয়ে দেবে? কে মাঠে দুপুরবেলা ঠা-ঠা রোদে ভাত দিয়ে আসবে? কে কাজ থেকে ছুটতে ছুটতে বাড়ি ঢুকে এক হাতে বাচ্চা সামলাবে, আর এক হাতে রাতের রান্না বসাবে? একই সঙ্গে কাজ থেকে বাড়ি ফিরে স্বামীর মুখের কাছে ধূমায়িত চায়ের কাপ হাজির করবে কে? নিজেকে নিঃস্ব করে রোজগারের শেষ কড়িটি পর্যন্ত স্বামীর হাতে তুলে দেবে কে? সর্বোপরি, বাবুসোনাদের যখন যৌন খিদে পাবে, তখন তাদের ভুলিয়েভালিয়ে ঘুম পাড়াবে কে? আমাদের রাষ্ট্র সাধারণত বাবুসোনাদেরই প্রতিনিধিত্ব করে। সেই জন্যই বিয়ের মধ্যে ধর্ষণের স্বীকৃতি দিতে নারাজ আমাদের রাষ্ট্র। আর কী পোড়া কপাল এ দেশের মেয়েদের! বিবাহ নামের এই ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানটি, যা কিনা স্ত্রী স্বামীর যৌন জুলুমের প্রতিবাদ করলেই টুক করে ভেঙে যাবে, তা টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের জীবনমরণ পণ করে নিজেদের ভালো বউ প্রমাণ করতে হয়। স্বামীর যৌন নির্যাতন মুখ বুঝে সহ্য করে প্রমাণ দিতে হয়, তারা সত্যবাদী।

যৌন নির্যাতন, তা সে স্বামী অথবা অপরিচিত ব্যাক্তি যার দ্বারাই ঘটুক না কেন, তা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। মেয়ের শরীরে শুধুমাত্র তার নিজেরই অধিকার। রাষ্ট্রপুঞ্জের কনভেনশন অন এলিমিনেশন অব অল ফর্মস অব ডিসক্রিমিনেশন আগেনস্ট উইমেন-এর কমিটি ২০১৪ সালে তার প্রতিবেদনে ভারতকে আইন সংশোধন করে বিয়ের মধ্যে ধর্ষণকে আইনের আওতায় আনার আবেদন করেছে। প্রসঙ্গত, ১৯৯৩ সাল থেকে ভারত এই কনভেনশন মানতে চুক্তিবদ্ধ। সারা পৃথিবীতে ১০০টিরও বেশি রাষ্ট্র বিয়ের মধ্যে ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। আমেরিকা, ইউরোপের অধিকাংশ দেশ থেকে শুরু করে প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা, ভুটান, নেপাল, পাকিস্তান পর্যন্ত বিয়ের মধ্যে ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে। ভারত হাতে গোনা কয়েকটি দেশের মধ্যে পড়ে যারা এখনও বিবাহিত সম্পর্কে ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গ্রাহ্য করতে রাজি নয়। সারা দেশের মেয়েরা, ন্যায়কামী মানুষ আজ পরিবর্তনের দাবি তুলছেন। কত দিন কানে তুলো গুঁজে থাকবেন রাষ্ট্রের মাথারা?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন