চিনের যুবক ঝেং চাচা সম্ভবত মহাকবি কালিদাসের সন্ধান পান নাই। নচেৎ জানিতেন, তাঁহার মনের কথাটি অনেক আগেই কবি বলিয়া গিয়াছেন। গৃহিণী কেমন হওয়া বিধেয়, ‘রঘুবংশম’-এ কালিদাস গুছাইয়া তাহার বর্ণনা করিয়াছেন। গৃহিণী সচিব হইবেন, অর্থাৎ অন্তরালে থাকিয়াই তিনি সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব নির্বাহ করিবেন। তিনি সখী হইবেন, অর্থাৎ স্বামীর সহিত সুমধুর সময় অতিবাহিত করিবেন। কিন্তু কখনও স্বামীকে ছাড়াইয়া যাইবেন না— প্রিয়শিষ্যার ভূমিকাও তাঁহাকেই পালন করিতে হইবে। এবং, তিনি কলাবিদ হইবেন। কাব্য, সংগীত হইতে শৃঙ্গার, সবেতেই তাঁহাকে পটীয়সী হইতে হইবে। ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে চালাচালি হওয়া হাস্যকৌতুকগুলিকে সাক্ষী মানিলে বলিতে হয়, এই ২০১৭ সালে এমন স্ত্রীর সন্ধান পাওয়া— ডনেরই ন্যায়— শুধু মুশকিলই নহে, না-মুমকিন। অবশ্য, তেমন বউ গত শতাব্দীতেও মিলিত না। ‘কচি সংসদ’-এ কথক স্ত্রীর মুখনিঃসৃত ‘হোয়াট্ হোয়াট্ হোয়াট্’ শুনিয়াই টের পাইয়াছিলেন, ‘পর্ব্বতো বহ্নিমান’। গন্তব্য বদলাইয়া দার্জিলিং যাওয়ার সিদ্ধান্ত করিতে তাঁহার বিন্দুমাত্র সময় লাগে নাই। সেই গল্পেই বেনারসের যাদব ডাক্তারের পুত্র কেষ্ট যে পাত্রী নির্বাচনের জন্য হাইকোর্টশিপ-এর ব্যবস্থা করিয়াছিল, তাহা অকারণে নহে। কালিদাস বা রাজশেখর বসুর নাম না জানিলেও ঝেং চাচা বুঝিয়া লইয়াছেন— পছন্দসই বউ চাহিলে তাহা নিজে বানাইয়া লওয়া ভিন্ন উপায় নাই। চাচা-র সুবিধা, তিনি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স লইয়াই কাজ করেন। তিনি একটি বিবাহযোগ্যা রোবট বানাইয়া তাহারই পাণিগ্রহণ করিয়াছেন। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের উদাহরণটি যদিও ভুলিবার নহে, তবু চাচা আশাবাদী হইতে পারেন: রোবটে মুখঝামটা দেয় না।
রোবট বিবাহ করিবার মধ্যে চমক বিলক্ষণ রহিয়াছে, কিন্তু আরও বেশি আছে বিচক্ষণতা। এবং, সেই রোবট যদি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে রচিত হয়, তবে কথাই নাই। ভিজা তোয়ালে বিছানায় রাখিলে রোবট-বউ বিনাবাক্যে তাহা মেলিয়া দিবে, বন্ধুবান্ধবদের সহিত আড্ডা মারিয়া বাড়িতে ফিরিলেও হাসিমুখে চায়ের পেয়ালা আগাইয়া দিবে, সাড়ে সাত বৎসরের পুরানো প্রসঙ্গ তুলিয়া বিবাদ বাধাইবে না, গোঁসা হইলেই রাত্রে তাহার মাথা ধরিবে না। সর্বোপরি, বউ রোবট হইলে শাশুড়ি থাকে না। ঝেং চাচা কালক্রমে যুগপুরুষের মর্যাদা পাইবেন, অনুমান করা চলে। প্রেম যাহা পারে নাই, বিজ্ঞান তাহাই সম্ভব করিয়াছে— যেমনটি চাই, ঠিক তেমন বউ পাইবার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছে।
তবে, যে কারণে ঝেং চাচা রোবটকে বিবাহ করিতে মনস্থ করিলেন, তাহা ভাবাইয়া তুলিতে পারে। বহু চেষ্টাতেও তাঁহার বান্ধবী জুটে নাই। প্রেম করিবার জন্য, হৃদয় দেওয়া-নেওয়ার জন্য যতখানি সংযোগের প্রয়োজন, এই মোবাইল ফোন-সর্বস্ব সময়ে কি সেই সংযোগ ক্রমেই বিরল হইতেছে? রক্তমাংসের কোনও মানুষের সঙ্গে সময় কাটাইবার পরিবর্তে মানুষ কি ক্রমে একটি পাঁচ ইঞ্চির স্ক্রিনেই নিজেকে আবদ্ধ করিয়া ফেলিতেছে? হাজার মতানৈক্য সত্ত্বেও দাম্পত্যের যে মজা, তাহা উপভোগ করিবার মতো মেন্টাল ব্যান্ডউইড্থ কি আত্মসর্বস্ব এই সময়ে থাকিতেছে না? রোবট-বউ প্রাপ্তির আনন্দে সম্পূর্ণ ভাসিয়া যাইবার পূর্বে এই প্রশ্নগুলির উত্তর সন্ধান করাও প্রয়োজন।