আমাদের চার পাশে এই প্রতিবেদকের মতো অনেকেই আছেন, যাঁরা বহুদিন আগে স্কুলকলেজের গণ্ডি পার করে আসা সত্ত্বেও প্রায়ই এই দুঃস্বপ্ন দেখে মাঝরাতে ঘেমে-নেয়ে উঠে বসেন যে, পরীক্ষার হলে বসে আছেন, সামনে খোলা অঙ্কের প্রশ্নপত্র এবং একটাও অঙ্ক পারছেন না। অন্যান্য দেশের কথা জানি না, কিন্তু আমাদের দেশে ‘অঙ্কে ভাল’ ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় ‘অঙ্কে কাঁচা’-রাই যে সংখ্যাগরিষ্ঠ তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ কম। মাধ্যমিকটা পাশ করার পর অনেকেই অঙ্কের বইকে চিরবিদায় জানান, কিন্তু অঙ্ক না পারার ব্যর্থতা তাঁদের সারাজীবন স্বপনে-জাগরণে তাড়া করে বেড়ায়।
ভয়ের উলটো দিকে অনেক সময়ই থাকে ভালবাসার অভাব। ‘আমরা যে অঙ্ককে এত ভয় পাই, তার কারণ হল, খুব ছোটবেলা থেকেই আমাদের অঙ্ককে ভালবাসতে সাহায্য করা তো দূর, বরং ভালবাসতে বাধা দেওয়া হয়।’ বলছিলেন কলকাতার একটি কলেজের অঙ্কের এক অধ্যাপক, ‘একেবারে শৈশবের কথা মনে করে দেখুন, দেখবেন, খুব ছোটবেলা থেকে অঙ্কের প্রতি আমাদের মনে একটা ভয়, একটা বিরূপ ভাবকে গেঁথে দেওয়া হয়।’
অঙ্কের প্রতি এই অনর্থক ভয়টাকে জয় করতে হলে যে একেবারে গোড়া মেরেই (অর্থাৎ শৈশব থেকেই) কাজটা শুরু করা উচিত, সেটা বুঝেছিলেন শ্যামবাজারের ‘কলিকাতা অনাথ আশ্রম প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এর মাস্টারমশাই উৎপল মুখোপাধ্যায়। মূলত তাঁরই উদ্যোগে ওই বিদ্যালয় চত্বরেই তিন দিনের একটা ‘গণিত উৎসব’ হয়ে গেল সম্প্রতি। শামিল হলেন ওই স্কুল সহ স্থানীয় আরও সাতটি স্কুলের মোট ৩৫ জন মাস্টারমশাই আর দিদিমণি। সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলপ্রাথমিক শিক্ষকদের অরাজনৈতিক সংগঠন ‘শিক্ষা-আলোচনা’, সর্বশিক্ষা মিশন, কলকাতা জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদ এবং একাধিক সংস্থা। সমবেত প্রচেষ্টায় মাস তিনেক ধরে নানা পরিকল্পনা, মডেল তৈরি, ছাত্রছাত্রীদের ট্রেনিং দেওয়ার কাজ চলে।
উৎসব প্রাঙ্গণের প্রথম স্টলটির সামনে দাঁড়াতেই ক্লাস ওয়ানের পড়ুয়া ঝুমা রায় একটা ছোট্ট ছিপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে রিনরিনে গলায় আদেশ করল, ‘মাছ ধরো’। দেখলুম, সামনের টেবিলে থার্মোকল দিয়ে বানানো একটা নকল পুকুর আর তাতে কাগজের তৈরি মাছের ঝাঁক। ছিপের সুতোর আগায় বঁড়শির বদলে ছোট্ট একটা চুম্বক ঝুলছে। বঁড়শিটা ‘পুকুরে’ ফেলতই অনেকগুলো ‘মাছ’ ওতে আটকে গেল। (বোঝা গেল, কাগজের নীচে পাতলা টিনের পাত লাগানো রয়েছে)। ‘কটা মাছ ধরলে?’ ঝুমার প্রশ্নে উত্তর দিতে হল, ‘চারটে’। ‘আচ্ছা’, বলে ঝুমা ভারী ব্যস্ত হয়ে পাশের কাঁচের পাত্রে রাখা অজস্র কাগজের টুকরোর মধ্য থেকে ‘৪’ লেখা একটা কাগজ বার করে থার্মোকলের বোর্ডে পিন দিয়ে সেঁটে দিল। দিয়েই আবার হুকুম, ‘আবার মাছ ধরো’। ঝুমার মিনিট পাঁচেকের ডিমনস্ট্রেশন শেষ হতেই দেখা গেল, যোগ শেখা হয়ে গেছে।
ক্লাস ফোর তুলনায় উঁচু ক্লাস। দেবযানী, কৃষ্ণাদের স্টলে তাই কাগজের তৈরি নানা রকম আনাজপাতি, ফল ইত্যাদির মডেল। প্রত্যেকটা জিনিসের সামনে ‘দাম’ লেখা কাগজ সাঁটা। এক জন মাস্টারমশাই কিছু নকল পাঁচশো আর হাজারের নোট নিয়ে সামনে বসে ছিলেন। প্রত্যেক দর্শনার্থীর হাতে একটা করে ‘নোট’ ধরিয়ে দিয়ে তিনি হাসতে হাসতে বলছেন, ‘লোন পেয়ে গেলেন, এ বার যান, পছন্দমত জিনিসপত্র কেনাকাটি করুন’। আপনি হয়তো পাঁচটা আপেল, দু-ডজন কলা, দুটো বেগুন আর ছটা কুমড়ো কিনলেন। টেবিলের উলটো পাশে দাঁড়ানো দেবযানী অমনি এক টুকরো কাগজে ঝটপট হিসেব কষে কাগজটা আপনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে স্মার্টলি বলল, ‘দেখে নিন, আপনি মোট দুশো আটত্রিশ টাকার জিনিস কিনেছেন’। এত দ্রুত হিসেব কষা হয়ে যেতে দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে আপনি ওর দিকে সেই ‘পাঁচশো টাকার নোট’টা এগিয়ে দিতেই অরুণিমা চট করে আবার সেই কাগজেই অঙ্ক কষে নিয়ে, ‘ক্যাশবাক্স’ খুলে গুনে-গেঁথে দুশো বাষট্টি ‘টাকা’ বার করে আপনার হাতে ধরিয়ে দিল। সেই সঙ্গে অবশ্য কাগজে লেখা হিসেবটা নিঁখুত ভাবে আপনাকে বুঝিয়ে দিতেও ছাড়ল না।
ছাত্রজীবনে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ‘অঙ্কের জাহাজ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন যে সমস্ত মাস্টারমশাই, যাঁদের চকের ডগা বেয়ে শক্ত শক্ত সব সমীকরণ হড়হড়িয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে নেমে আসত, তাঁদের দিকে আমরা বরাবরই বিস্ময়-মিশ্রিত সমীহের দৃষ্টিতে তাকাতাম। প্রথম সারিতে বসে থাকা একটি-দুটি অতি-মেধাবী ছাত্র বা ছাত্রী বাদে বাকিরা সেই অঙ্কটা আদৌ বুঝল কি না তা নিয়ে তাঁরা খুব একটা মাথা ঘামাতেন না।
ঝুমা, আদৃতা, তিতলি, কৃষ্ণারা কিন্তু সামনে দাঁড়ানো প্রত্যেক অতিথিকে একই রকম আনন্দের সঙ্গে, যত্ন নিয়ে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ শিখিয়েছে, মৌলিক সংখ্যা চিনিয়েছে, নামতার রহস্য বুঝিয়েছে। তাই মনে হচ্ছিল, রাজ্যের জেলায় জেলায়, এমনকী প্রতিটা ব্লকে সরকারি উদ্যোগে এমন গণিত-উৎসব করা যায় না?