সোনার আলোয় আজও ভেসে ওঠে ছুটির ছবি

সে সময় আমাদের কাছে পুজো আসাটা ছিল অনেকটাই পাটকেন্দ্রিক। পাট কাটা শুরু হলেই আমরা বুঝতাম, পুজোর ঘণ্টা বেজেছে। লিখছেন সুদীপ জোয়ারদারবিকেলে মোড়ক খুলে দেখা গেল তিনটে সেন্টের শিশি। কোনটার কেমন গন্ধ জানার ইচ্ছে সকলেরই। প্রথমটা খুলতেই পাওয়া গেল শিউলির সুবাস।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৯ ০২:৪০
Share:

ছবি: সংগৃহীত

বাঙালির যৌথ পরিবার এখন ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু গল্পে তা রাখতে অসুবিধে কোথায়? গল্পে, এমনই এক পরিবারে পুজোর ক’দিন আগে একটা সেন্টের মোড়ক, এখনকার ভাষায় ‘কম্বো প্যাক’ গছিয়ে দিয়ে গেলেন এক সেন্ট-বিক্রেতা। কেনার ইচ্ছে তেমন ছিল না পরিবারের কারও। কিন্তু বাদ সাধল সেন্টের মোড়কের নামটা। ‘পুজোর গন্ধ’। এমন মনকেমন করা নামের কোনও সেন্ট কি পুজোর সময়ে না কিনে থাকা যায়!

Advertisement

বিকেলে মোড়ক খুলে দেখা গেল তিনটে সেন্টের শিশি। কোনটার কেমন গন্ধ জানার ইচ্ছে সকলেরই। প্রথমটা খুলতেই পাওয়া গেল শিউলির সুবাস। দ্বিতীয়টা খোলা হলে পরিবারে এক জন শুঁকে বললেন, ‘আঃ, কত দিন খাইনি!’ সেন্ট তো খাবার জিনিস নয়। তা হলে? দেখা গেল, সেন্টের শিশি দিয়ে বের হচ্ছে নারকেল নাড়ুর গন্ধ।

এ বারে তৃতীয়টা খোলার পালা। এটা খুলে একে একে নাকের কাছে ধরতেই চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেল সবার। কারও আর্তনাদ, ‘ম্যা গো’, কেউ বললেন, ‘বমি হয়ে যাবে।’ সেন্টের কম্বো প্যাকে এমন একটা ভেজাল দেখে, কেউ আবার রাস্তায় সেন্ট বিক্রেতাকে দেখলে দেখে-নেওয়ার হুমকিও দিলেন। পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক সদস্যের কাছে তখনও পৌঁছয়নি সেন্টের শিশিটা।

Advertisement

তাঁর হাতে ওটা যেতেই তাজ্জব কাণ্ড। এমন একটা বাজে গন্ধের সেন্ট তিনি শুঁকেই চললেন, শুঁকেই চললেন। রহস্যটা কী? প্রবীণ মানুষটি বললেন, ‘পুজোর আসল গন্ধটা চিনতে পারলি না! গ্রামের নয়ানজুলি, খাল, বিল সব যে ওতে এ সময় ভরে থাকত রে!’ তিনি সেন্টের শিশিটা আবার এক বার শুঁকে বললেন, ‘পচা পাটের গন্ধের কাছে কোথায় লাগে পুজোর আর সব গন্ধ!’

বেশ অনেক কাল আগে নিজের লেখা এই গল্প পুজো এলেই মনে পড়ে। আসলে এ তো নিছক গল্প নয়। পচা পাটের গন্ধ যে তখনকার গ্রামজীবনে পুজোর এক অন্যতম অনুষঙ্গ। বেশ কয়েকটা ফাঁকা জমির মাঝখানে ছিল আমাদের গ্রামের বাড়ি। ফলে অনেকটা সময় তখন আমরা পাটবন্দি থাকতাম। ভাদ্রের সোনাগলা রোদটা বেরোতেই বিভিন্ন জমির পাট একে একে কাটা শুরু হত। আমাদের সে কী উল্লাস! কোনও দিন বেরিয়ে পড়েছে পঞ্চায়েত অফিস, কোনও দিন রেললাইন, কোনও দিন আমাদের খেলার মাঠ। বাড়ি থেকে আবার দেখা যাচ্ছে চারপাশ। যেন মুক্তির আনন্দ। এখন পুজো আসে কত ভাবে। সে সময় আমাদের কাছে পুজো আসাটা ছিল অনেকটাই পাটকেন্দ্রিক। পাট কাটা শুরু হতেই আমরা বুঝতাম, পুজোর ঘণ্টা বেজেছে।

পাট-কাটা জমির উপর দিয়ে হাঁটা বেশ কষ্টের। কিন্তু খালিপায়ে চৌহদ্দি-চরে বেড়ানো আমরা সে কষ্টে সাড়া দিতে পারি! বাড়ির ছাগলগুলো যে লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জমিতে কাটা পাটের পাতার দিকে। নিয়ে যেতে হবে না তাদের! আজ ভাবলে অবাক হই, তখন ওই পাট-কাটা জমির উপর দিয়ে পায়ে কোনও খোঁচা না লাগিয়েই আমরা খালিপায়ে দিব্যি হেঁটে যেতাম।

পাট কাটা হলেই পাটের গল্প শেষ হয়ে যেত না। বরং এ বার শুরু হত আসল গল্প। যেখানে একটু জল, সেখানেই শুয়ে আছে পাট। তখনও ডেঙ্গি আসেনি, কিন্তু ম্যালেরিয়া ছিল বিলক্ষণ। পাট পচাতে দেওয়া খাল, বিল, ডোবা, পুকুরের পাশ দিয়ে যাওয়া যেত না। একেবারে ছেঁকে ধরত মশার দল। আর সেই গন্ধ, যা পেলে এখন নস্টালজিক হয়ে পড়ে এই নাগরিক ‘আমি’, সেই গন্ধে তখন একেবারে ‘মাতোয়ারা’ হয়ে যেত সারা গ্রাম। এখন নস্টালজিয়া, তখন কিন্তু বলতাম, ‘গন্ধে টেকা দায়!’

এইসব পাট-কিস্্সার মধ্যে পুজোটা চলে আসত গুটি গুটি পায়ে। অবশেষে পুজো যখন কড়া নাড়ছে, তখন দেখতাম পাট ও পাটকাঠি গৃহস্থের উঠোন-বাগানে হা পিত্যেশ করে বসে আছে রোদের জন্য। রোদের জন্য, কেননা আকাশ তখন এক মূর্তিমান অস্থিরতা। এই ভাল তো এই মন্দ।

পাট বিক্রি হলে তবেই আসবে পুজোর জামাকাপড়। পাটের ক্রেতারা চরকি দিত গ্রামে। বছরকার দিনে ছেলেপুলেকে নতুন জামা দিতে হবে, গৃহস্থের এই সেন্টিমেন্টের খবর তাঁরা জানেন। তাই ঠকানোর ফন্দিফিকিরও তাঁদের তরফে কম থাকত না। এ সবের মাঝেই এখানে ওখানে পাট কুড়িয়ে পুজোর হাতখরচ জোগাড়ে লেগে পড়ত গ্রামের ছেলে ছোকরার দল। তার পরে রাজগঞ্জের ঘাটে বাঁধা পাট বোঝাই ‘মধুমাঝির ওই যে নৌকাখানা’র মতো গ্রামের রাস্তায় আমরাও দেখতাম, পাটবোঝাই নানা স্থলনৌকো, গরুর গাড়ি, ম্যাটাডোর এবং লরি।

পুজোর আর এক আশ্চর্য জিনিস ছিল শরতের রোদ। এই রোদ আজ এলেও তখনকার মতো সে আর আসে কি? সেই সে ভাবে ‘যে দিকে তাকাই সোনার আলোয়/দেখি যে ছুটির ছবি!’ সময় কত কিছুই কেড়ে নেয়! তবে রোদ নিয়ে তখন ভাদ্রে বাড়ির বড়দেরও কিন্তু অনেক কাজ। আকাশ ভাল। রোদ উঠেছে। অতএব এইবেলা ঘরের খড় পালটে দাও। দূর গ্রাম থেকে খড় আসবে গরুর গাড়িতে। আমরা চেয়ে থাকি রাস্তার দিকে। তার পরে খড় আসে, আসে ঘরামির দল। পাক্কা দু’দিন আমরা ঘরচ্যুত। সবাই মিলে কষ্টেসৃষ্টে কাটিয়ে দিই পাশের টালির চালের ছোট্ট ঘরটায়। আর খড় যেদিন বদলানো শেষ হয়, সে দিন তো শরতের রোদ আর চালের খড়ের সোনালি রং মিলেমিশে একাকার। আমাদের একেবারে, ‘দেখে দেখে আঁখি না ফিরে’ অবস্থা।

এর পরেই রোদের দিকে তাকিয়ে শুরু হত মাটির ঘরগুলোর দেওয়াল নিকোনোর কাজ। নিকোনোর পরে গোবরের কী চমৎকার পবিত্র গন্ধ বের হত সারা বাড়ি থেকে! আমরা খুশিতে উদ্বেল। পুজোটা এ বার সত্যিই আসছে তা হলে! ভাদ্রের কড়া রোদের প্রয়োজন তখন আরও একটা কারণে। নষ্টের হাত থেকে বাঁচাতে পুরোনো জামাকাপড়গুলোকে ভাদ্রের রোদ খাওয়াতে হবে। বাক্স খুলে খেজুর পাতার মাদুরে বাক্স থেকে পুরোনো জামাকাপড় মেলে আমরা তখন ঠায় বসে থাকি পাহারায়। কোনও কুকুর না উঠে যায় ওতে। পুরোনো জামাকাপড়গুলো নিয়ে তখন কত জিজ্ঞাসা। এটা কবেকার? ওটা কবেকার? কোনও পোশাক আবার ওই মাদুর থেকেই নতুন করে পরিচ্ছদের মহিমা পেত। এক বার পুরো ভাদ্র জুড়ে বর্ষণ। পুজোর আগে রোদই পেল না বাক্সবন্দি জামাকাপড়। এই নিয়ে পুজোর ঠিক আগে এক বর্ষণমুখরিত দ্বিপ্রহরে আমরা আক্ষেপ করছিলাম। আলোচনা চলছিল, কার কোন পোশাক রোদ পেল না। কবে কে দিয়েছিল সে পোশাক ইত্যাদি।

শিক্ষক, ভগবানগোলা হাইস্কুল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন