আপনার অভিমত

নায়কের যতটুকু দরকার, নায়িকার কদরও ততটুকুই

যখন নন্দদুলাল চলে যাচ্ছে ব্রজ ছেড়ে, কাব্য থেকে রাধারও অধিকার চলে যাচ্ছে। তার বেদনাও বড় ম্লান। আর যেন রাধাকে দরকারই নেই। লিখছেন মণিদীপা নন্দী বিশ্বাসযখন নন্দদুলাল চলে যাচ্ছে ব্রজ ছেড়ে, কাব্য থেকে রাধারও অধিকার চলে যাচ্ছে। তার বেদনাও বড় ম্লান। আর যেন রাধাকে দরকারই নেই। লিখছেন মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৮ ০৩:০০
Share:

সে বাতাসে হেমন্তের হিম শিশির। শিশিরটুকুর ছোঁয়া চন্দনপাটায় জলের সঙ্গে মিশে থাকে, আর সে চন্দনে টিপ পরে কয়েকজন সার বেঁধে মহারাজ হয়ে যান। একদিনের রাজা। ভারি মজার সে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, সাদা চন্দন, লাল চন্দন, দই, ঘি, কাজলের কত না টিপের মিশ্রণ। আর পাতের পাশে ডিশে সাজানো লুচি মিষ্টি মাংসের সমাহার। কিংবা সরু সরু বেগুনভাজা। গোল গোল করে কাটা। আর তারপর?

Advertisement

সকালের সে পর্ব মিটতে না মিটতেই বোনেদের নিয়ে কেউ সিনেমা,কিংবা এখনতো রকমারি ট্যুর। ছোটখাট...এদিক ওদিক, ডুয়ার্স হলে তো কথাই নেই। হয় অরণ্য নয়তো নদী, অথবা অরণ্য, নদী, পাহাড়ের সমাবেশ। ছোটবেলাগুলো আছে বলেই তো প্রকৃতির সবুজ বেঁচে রয়েছে, বেঁচে রয়েছে ঘাস, কচি ঘাসের উপর ভোরবেলার হিমটুকু।

কে আগে ঘুম ভেঙে দৌড়ে সেই শিশিরটুকু ঠাকুরঘরের গ্লাসে বা পাথর বাটিতে রাখতে পারে তার প্রতিযোগিতা। তখন মানে সেই সত্তর দশক জুড়ে আর আশির দশকের প্রথম পর্ব জুড়ে মনে হত, এরাই তো আমার। নিজের রক্ত বইছে শরীরে। যমকে যেমন যমুনা ফোঁটা দিয়ে মঙ্গল কামনা করে, শত সহস্র বছরের আয়ু প্রার্থনা করে, ঠিক তেমনই মন ঘিরে সে সব স্বপ্ন ঘর ছিল। বারো বছরের এক বালিকা পেয়েও গেল যৌথ বাড়ির বারান্দায় সব শেষের ছোট্ট আসনে বসার মতো এক ফুটফুটে ডাগর চোখের ভাই। পরিপূর্ণ আশটুকু। যার শরীরে রক্তধারায় সেই মেয়েরই নাম।

Advertisement

যাক্ গে, সে সব তো ইতিহাস। নারীর কি কোন ভৌগোলিক অবস্থান, নিজস্ব নাম খোদাই করা থাকে নাকি! ছেড়ে আসাই বদান্যতা, মহানুভবতা। আর কন্যা ভাল আছে দূরে থাক যেখানেই থাক, তাতেই শান্তি বাবা, মায়ের। আসলে বাতাসে হেমন্তের রূপশালী ধানের পাকা গন্ধ উঠে আসছে আর মন কেমনের অসুখ যাদের সেই মানুষেরা নীল আকাশের পড়ন্ত রোদ্দুরে চোখ মেলছে আর শরৎকালীন উৎসবের শেষ আয়োজন ভাইফোঁটার ছবি দেখছে। লম্বা বারান্দার আসন পিঁড়ির ভাইয়েরাও যেমন অন্যভাবে ফোঁটা পরিবর্তিত হতে দেখেছে সময়ের টানে তেমনই দিদি বোনের ভিড়ও কমতে কমতে এক এক্কে এক বা দুই এক্কে দুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

কিন্তু সে কথা তুলে রেখেছি সেই কুলুঙ্গিতে, তুলে রাখা পুরোনো বাক্সের মতো। চলতি পথে একে একে ঈশ্বর খুঁজে পেয়েছি আমি ভাইয়ের আদলে। যাঁদের সঙ্গে রক্ত সম্পর্ক কথা বলে না। দুরন্ত মানবিক সম্পর্ক উঠে আসে সার বেঁধে। সংসার নারীকে একা করে, স্বাবলম্বীও করে। এ কিন্তু পরম শক্তি অর্জন করা। আমার নেই, কিছুই পেলাম না জীবনে, নিঃস্ব...এসব বোধগুলো থাকবেই না যদি বিশ্ব দরবারের অগণিত ঈশ্বরমুখী মানুষের কাছাকাছি পৌঁছোনো যায়। তাদের সঙ্গে পা মেলাতে মেলাতে কত মানুষ যে কর্মজগতের তালিকায় এসে পড়েছে কাকে ছেড়ে কার নাম বলি!

জলপাইগুড়ির নামী সরকারি স্কুলে প়ঁচিশটি বছর। পড়ানো ছাড়াও বুকের ভিতর নানা তাগিদ। পেরিয়ে গিয়েছি ডুয়ার্স বাগান, পেয়েছি হেমলতাদির মতো মানুষ যিনি চা বাগানেই মানুষ। দেখেছেন কষ্ট কাকে বলে। তাঁর সঙ্গে পৌঁছে গিয়েছি গাঙ্গুটিয়া চা-বাগান সনৎদার কাছে। গুণি মানুষ, দৃষ্টি হারিয়েছেন। আমাকে ছুঁয়ে দেখেছেন, তাঁর বন্ধুকন্যার স্পর্শ নিতে চেয়েছেন। একের পর এক গান যেমন শুনেছেন তেমনই নিজেও শুনিয়েছেন কত অনুবাদ, দেখিয়েছেন পুরস্কার, বাঁধানো মানপত্র। প্রেরণা নিয়ে ফিরে এসেছি ডুয়ার্সের অন্য বাগানগুলোয়। রবীন্দ্রনাথের গান, তাঁর মর্মবাণী পৌঁছতে চেয়েছি আমার মতো করে শ্রমজীবী অন্তরে। চলার সে পথ তো সবসময় মসৃণ ছিল না। সাহায্য করেছেন কত মানুষ। আমার ছাত্রীরাও কি বাদ যাবে এ তালিকা থেকে, কখনওই না। তাদের নিয়েই আমার রবীন্দ্রবীথি। ভাইফোঁটার প্রাক্কালে জলপাইগুড়ির সবচেয়ে হিতৈষী হিসেবে দু’হাত বাড়িয়েছিলেন যিনি প্রথম সেই ব্যাঙ্ককর্মী জ্ঞানাঙ্কুর ভাদুড়ির কথা মনে হয়। আসলে হেমন্তের অবিরল পাতার মতো যারা চলে যায় তারা আর ফেরে না কখনও।

ভাইফোঁটার থালা সাজাই প্রদীপ তুলে দিই এখন আমার মেয়ের হাতে, সে ফোঁটা দেয় তার ভাইকে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি এই ভাইফোঁটাই কিভাবে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধে ছড়িয়ে যায় যেতে পারে। শুধু চাই একটুখানি ইচ্ছের পরশ। শুভ ইচ্ছের জাগরণের ফলেই তো দেখি এখানকার বিভিন্ন হোমগুলোয়, অনাথ আশ্রমে, সংশোধনাগারে একঝাঁক ভাইয়েরা তাদের বোনেদের হাত থেকে ফোঁটা নিচ্ছে,বোনেরাও। এ ইচ্ছেগুলোই তো প্রাণে জ্বালিয়ে রাখে শুভ আলো।

কিন্তু তখনই ভাবি, বোনদের জন্য কী করে ভাইরা? তখনই ভাবি নারীকে কী চোখে দেখে পুরুষ?

জীবনের মানেটা এ মধ্য বয়সে বদলে গিয়েছে অনেকটাই। আমার কাছে আমার জন্মভূমি বিদেশ বিভুঁই এখন। সেখানেও আমার সহকারি ভাইয়েরা দাঁড়িয়ে থাকে যে কোনও পরিস্থিতিতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে। কর্মক্ষেত্রে সেই জন্যই অবসর নেওয়া দাদাটিও পরম যত্নে এখনও পাশে থাকেন।

কিন্তু এই পাশে থাকাটা যেমন ভাল, তেমনই মনে হয়, আমি কতটা অপেক্ষা করে থাকি দাদার জন্য? সারা জীবনে কতটা অপেক্ষা করে রয়েছি পরিবারের কোনও না কোনও পুরু‌ষের জন্য? সমাজ আমাকে কতটা অপেক্ষা করিয়ে রেখেছে সেই জন্য?

এখন নতুন আইন হচ্ছে। তাতে সম্পর্কের ব্যাখ্যা বদলাচ্ছে। সেই ব্যাখ্যায় নারী অনেক স্বাতন্ত্র্য পাচ্ছে। অনেক সাহস পাচ্ছে। কিন্তু ভয় অন্যত্র। মানুষ বদলাচ্ছে। সময় বাদলাচ্ছে। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। তাই সম্পর্কেরও বদল অবশ্যম্ভাবী। সম্পর্ক নিয়ে চিন্তার পরিবর্তনও অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু সেই চিন্তা আমাদের জীবনে কিভাবে ব্যবহার করব, তা স্থির করার কোনও নির্দিষ্ট ব্যাকরণ নেই। আর সেই ব্যাকরণ নেই বলেই, ভয় হয়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ অপব্যাখ্যা করবে না তো? কোনও সুযোগ নেবে না তো? কার কাছে সাহায্য চাইব? সে-ও তো পুরুষই। সে সরে যাবে না তো? নারীকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেখে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কেমন প্রতিক্রিয়া হবে?

যেমন, কৃষ্ণ-রাধার কাহিনি প্রধানত পুরুষ কবিদের লেখা। সেই লেখায় রাধা বড় মধুর। বড় কোমল। তার নিবেদন বড় আদরণীয়। আর সেই রাধাকে বৃহত্তর কাজের জন্য যখন ব্রজনন্দন বরাবরের মতো ছেড়ে চলে যায়, আমাদের সেই পুরুষতান্ত্রিক সাহিত্য নীরব থাকে। রাধার বেদনা আর তার কাছে খুব বড় কথা নয়। এরপর উঠে আসে মহাভারতের সেই প্রচণ্ড পুরুষ কৃষ্ণ, যে যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ করে।

এই প্রসঙ্গের কথা আসে এই কারণেই যে, সেই প্রচণ্ড পুরুষের প্রেমের অধিকার মেনে নিতে গিয়ে রাধার পরকীয়াও মেনে নেওয়া হচ্ছে, তাকে শাস্ত্রের ব্যাখ্যায় বরণও করা হচ্ছে, কিন্তু তারপরে যখন নন্দদুলাল চলে যাচ্ছে ব্রজ ছেড়ে, কাব্য থেকে রাধারও অধিকার চলে যাচ্ছে। আর যেন রাধাকে দরকার নেই।

ভয় এখানেই। যতক্ষণ পুরুষের দরকার, নায়কের দরকার, ততক্ষণই কি প্রেমিকার প্রয়োজন? তারপরে? যখন প্রয়োজন ফুরোবে?

তবে আশার কথা, নবীন ভারতের রাধা তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন