মনোরোগীও এ বার আসিলেন স্বাস্থ্যবিমার অধীনে। এই বিধি নূতন মানসিক স্বাস্থ্য আইন-এর (২০১৭) অন্তর্গত। সম্প্রতি বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা (আইআরডিএ) এ বিষয়ে সকল বিমা কোম্পানির নিকট নির্দেশ পাঠাইয়াছে। স্বস্তির সংবাদ। মনোরোগের বিস্তার বাড়িতেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে চার জনের এক জনই আক্রান্ত মানসিক অথবা স্নায়ুতন্ত্রের এমন রোগে, যাহা আচরণে ও জীবনে প্রভাব ফেলিতেছে। অধিকাংশেরই চিকিৎসা মিলে না। রোগীরা কেহ শিকলবন্দি, কেহ ঘরবন্দি, কেহ হাসপাতালে পরিত্যক্ত, কেহ পথবাসী। কেহ বা কোনও ‘আশ্রম’ বা ‘হোম’-এ বন্দি হইয়া নিয়ত প্রহার সহ্য করিতেছেন। রোগীর সুরক্ষা বা মর্যাদা তাঁহাদের জোটে না। কারণ, শারীরিক রোগকেই ‘অসুখ’ বলিয়া গণ্য করিতে সমাজ অভ্যস্ত। মনোরোগকে ‘বিকার’ কিংবা ‘অভিশাপ’ ভাবিয়া সকলে ভয় পায়, ঘৃণা করে। অথচ নিয়মিত চিকিৎসায় মনোরোগী স্বাভাবিক জীবনে ফিরিতে পারেন। ভারতে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের অন্তত পনেরো শতাংশ মনোরোগে আক্রান্ত। কিন্তু চিকিৎসক, নার্স, সমাজকর্মীর সহায়তা অধিকাংশের নিকট পৌঁছায় না। মনোরোগ বিমার অধীনে আসিবার অর্থ, অন্তত রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে শারীরিক এবং মানসিক রোগের পার্থক্য নাই। মনোরোগীর চিকিৎসার অধিকার অপরাপর সকল রোগাক্রান্তের সমান।
এই কলঙ্কমুক্তিই সম্ভবত সর্বাধিক লাভ। আরও কিছু লাভের সম্ভাবনা রহিয়াছে। এই রাজ্যের অনেক হাসপাতাল, এমনকি মেডিক্যাল কলেজগুলিও মনোরোগী ভর্তি করিতে অনাগ্রহী। নিয়ত নজরদারির লোক নাই, এই অজুহাতে রোগীরা প্রত্যাখ্যাত হন। বিমা সংস্থার টাকা মিলিতে পারে জানিলে পরিকাঠামো মজবুত করিতে, এবং প্রয়োজনীয় কর্মী নিয়োগে আগ্রহ বাড়িতে পারে। মনোরোগীদের জন্য নির্দিষ্ট বেসরকারি এবং সরকারি হোম, হাসপাতালগুলিতেও উন্নততর পরিকাঠামো গড়িবার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হইবে, আশা করা যায়। বিশেষত জেলাগুলিতে হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ বাড়িলে উপকার হইবে। মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনকেও ‘মনোরোগের চিকিৎসা’ বলিয়াছে মানসিক স্বাস্থ্য আইন। রাজ্যের পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলির অবস্থা যে কী ভয়ানক, পর পর কয়েক জন রোগীর মৃত্যু তাহা প্রমাণ করিয়াছে। বিমার অর্থ-সহায়তায় যদি সেগুলির কিছু উন্নতি হয়, তাহা বহু পরিবারে নূতন আশার সঞ্চার করিবে।
কিন্তু আসক্তিমুক্তিও কি আসিবে বিমার আওতায়? এখনও স্পষ্ট নহে। বর্তমানে মদ্যপানে যকৃতের ক্ষতি হইলে তাহার চিকিৎসা বিমার আওতাভুক্ত নহে। বস্তুত ভারতে মনোরোগীদের প্রয়োজনের অল্পই আসিবে বিমার আওতায়। কারণ হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় অতি অল্প রোগীর, এবং বর্তমানে স্বাস্থ্যবিমা প্রধানত হাসপাতালের খরচ মিটাইবার পরিবেষা। প্রাধান্য পায় অস্ত্রোপচার। অধিকাংশ মনোরোগীর প্রয়োজন আউটডোর পরিষেবা এবং নিয়মিত ঔষধ। এই জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবায় মানসিক চিকিৎসার অন্তর্ভুক্তির নির্দেশ দিয়াছে নূতন আইন। পাশাপাশি সকল স্তরের হাসপাতালে মনোরোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে হইবে। চাই প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী। দীর্ঘ উপেক্ষার পর আজ মনোরোগীর দাবি আসিয়াছে রাষ্ট্রের সম্মুখে।