পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধই আনে সংহতি ও মৈত্রী

দু’জনের মাঝখানে যদি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে অহং আর ঈর্ষার দেওয়াল তবে বিনষ্ট হয় মানসিক শান্তি, সৌভ্রাতৃত্ববোধ। শুরু হয় অসুস্থ প্রতিযোগিতা। লিখছেন সুদীপ্তকুমার চক্রবর্তীসাধারণত্বের গণ্ডি ছাড়ানো উচ্চ মানসিকতার মানুষদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অত্যুজ্জ্বল হয়ে থাকে যদিও অনবধানতা ও অজ্ঞতার কারণে আমরা, সাধারণ মানুষেরা অনেক সময় তাঁদের সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা করি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৯ ০১:৫৭
Share:

একটা ডিসক্লেইমার দিয়ে গল্পটা শুরু করা যাক: এই গল্পের সঙ্গে কোনও ধর্মীয় ভাবাবেগের তিলমাত্র সম্পর্ক নেই।

Advertisement

এক পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করতেন পাঁচ জন খ্রিস্টান সাধু। পরস্পরের প্রতি তাঁদের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে ঈর্ষা করতেন এবং পরস্পরের প্রতি ছিল তাঁদের তীব্র অসন্তোষ। এক দিন তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেন, ‘‘শান্তির আশায় আমরা ঘর ছেড়ে এসেছি। কিন্তু কোথায় শান্তি? সবারই যে বুকের ভেতর অসহ্য দহন জ্বালা। এই অসহ্য অবস্থা থেকে কী ভাবে ঘটবে উত্তরণ?’’

এর মধ্যে খবর পাওয়া গেল, ভারত থেকে এক বৃদ্ধ সাধু সেই পাহাড়ি অঞ্চলে আস্তানা গেড়েছেন। যদি তাঁর কাছে শান্তির সন্ধান পাওয়া যায় এই আশায় সেই পাঁচ জন খ্রিস্টান সাধু গেলেন তাঁর কাছে। নিবেদন করলেন তাঁদের বেদনার কথা। সেই ভারতীয় বৃদ্ধ সাধু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তার পরে বললেন, ‘‘আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আপনাদের মধ্যেই এক জন স্বয়ং যিশু। কোন জন আমি নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আপনাদের মধ্যে এক জন স্বয়ং যিশু।’’

Advertisement

গভীর চিন্তা আর উৎকণ্ঠা নিয়ে আশ্রমে ফিরলেন সেই পাঁচ জন খ্রিস্টান সাধু। এ বার প্রথম জন ভাবলেন, ‘‘আমার যা মানসিকতা তাতে আমি কখনও যিশু হতেই পারি না। তা হলে বাকি চার জনের মধ্যে এক জন নিশ্চয়ই যিশু।’’ অতএব তিনি শ্রদ্ধা করতে আরম্ভ করলেন বাকি চার জনকে। একই ব্যাপার ঘটল বাকি চার জনের ক্ষেত্রে ও। ফলে তাঁরা প্রত্যেকেই একে অন্যকে গভীর ভাবে শ্রদ্ধা করতে শুরু করলেন। সেই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ফিরে এল শান্তি, আনন্দ আর জীবনের স্বাদ।

এই গল্প থেকে যে বিষয়টি উঠে এল তা হল যেখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকে সেখানেই বিরাজ করে সংহতি, মৈত্রী ও সুস্থিতি। আমার আর আপনার মাঝখানে যদি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে অহং আর ঈর্ষার দেওয়াল তবে বিনষ্ট হয় মানসিক শান্তি, সৌভ্রাতৃত্ববোধ; শুরু হয় রেষারেষি আর খেয়োখেয়ির অনিবার্য, অসুস্থ প্রতিযোগিতা। কিন্তু পারস্পরিক শ্রদ্ধা যে স্বর্গীয় উষ্ণতা নিয়ে আসে তাতে দূর হয়ে যায় আমাদের যত তুচ্ছ ক্ষুদ্রতা ও মানসিক মলিনতা। পৃথিবীটা তখন স্বর্গ হয়ে ওঠে।

সাধারণত্বের গণ্ডি ছাড়ানো উচ্চ মানসিকতার মানুষদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অত্যুজ্জ্বল হয়ে থাকে যদিও অনবধানতা ও অজ্ঞতার কারণে আমরা, সাধারণ মানুষেরা অনেক সময় তাঁদের সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা করি। মতের অমিল থাকতে পারে, থাকতে পারে আদর্শগত পার্থক্যও কিন্তু তাতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের কোনও ঘাটতি হয় না।

একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে, রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ পরস্পর পরস্পরের প্রতি উদাসীন ছিলেন; এক কথায় বলা যায় যে, তাঁদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। কিন্তু ইতিহাস অন্য কথা বলে। শ্রীরামকৃষ্ণ যখন নরেন্দ্রর কাছ থেকে গান শুনতে চাইতেন তখন যে গানগুলি নরেন্দ্রনাথের কণ্ঠে গীত হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণকে ভাবে মাতোয়ারা করে তুলত তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ‘তোমারই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’ এই গানটি। এ ছাড়াও রয়েছে ‘একি এ সুন্দর শোভা’, ‘দিবানিশি করিয়া যতন’, ‘মহাসিংহাসনে বসি শুনিছ’-এর মতো এমন সব রবীন্দ্রনাথের গান। তখন নরেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ দু’জনেই তরুণ। শ্রদ্ধা ছিল বলেই নরেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের গান শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে গেয়েছিলেন।

আবার নরেন্দ্রনাথ যিনি পরবর্তীকালে বিশ্ববিশ্রুত বিবেকানন্দ, তাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছিলেন তা গভীর ভাবে তাৎপর্যবাহী ও অত্যুজ্জ্বল শ্রদ্ধার অতুলনীয় প্রকাশ।

১৯২৮ সালের ৯ এপ্রিল ড. সরসীলাল সরকারের পত্রের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘‘আধুনিক কালের ভারতবর্ষে বিবেকানন্দ একটি মহৎ বাণী প্রচার করেছিলেন, সেটি কোনো আচারগত নয়। তিনি দেশের সকলকে ডেকে বলেছিলেন, তোমাদের সকলের মধ্যে ব্রহ্মের শক্তি, দরিদ্রের মধ্যে দেবতা তোমাদের সেবা চান। এই কথাটা যুবকদের চিত্তকে সমগ্র ভাবে জাগিয়েছে। তাই এই বাণীর ফল দেশের সেবায় আজ বিচিত্রভাবে বিচিত্রত্যাগে ফলছে। তার বাণী মানুষকে যখন সম্মান দিয়েছে তখনই শক্তি দিয়েছে। সেই শক্তির পথ কেবল এক ঝোঁকা নয় তা কোন দৈহিক প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি রোধে পর্যবসিত নয়। তা মানুষের প্রাণ মনকে বিচিত্রভাবে প্রাণবান করেছে। বাংলাদেশের যুবকদের মধ্যে যেসব দুঃসাহসিক অধ্যবসায়ের পরিচয় পাই তার মূলে আছে বিবেকানন্দের বাণী যা মানুষের আত্মাকে ডেকেছে আঙুলকে নয়।’’ সংক্ষিপ্ত কিন্তু বিবেকানন্দ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা।

সহকারী প্রধান শিক্ষক, সারগাছি রামকৃষ্ণ মিশন উচ্চ বিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন