নরেন্দ্র মোদী ভুল স্বীকার করেন না, তারই ফল ভুগছে দেশ

মন্দ নীতি দেশের মন্দই করে

নরেন্দ্র মোদী যে কার পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেন, এবং কার সমালোচনায় কর্ণপাত করেন, দেশবাসীর কাছে তা এক রহস্য। মোদী সরকার কোনও নীতি (পলিসি) গ্রহণের আগে সেটি নিয়ে একটা উচ্চমানের, পরিশীলিত আলোচনা হয়েছে, এমন চোখে পড়ে না। যেটুকু জানা যায়, তিনি ২০১৫ সালে এক বার উচ্চপদস্থ আমলাদের থেকে উন্নয়ন সম্পর্কে কিছু প্রস্তাব চেয়েছিলেন।

Advertisement

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:৪১
Share:

নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে একটা কথা এত দিনে বোঝা গিয়েছে। তিনি কখনও ভুল স্বীকার করেন না, আফশোসও করেন না। পাঁচ বছরে কখনও বলেননি, এই রাস্তায় আগ বাড়িয়ে এতটা চলে আসা উচিত হয়নি। প্রকাশ্যে তো নয়ই, ঘনিষ্ঠদের মধ্যেও বলেন কি? জওহরলাল নেহরু সম্পর্কে জানা যায়, তাঁর ভুল ধরিয়ে দিলে তিনি গোড়ায় খাপ্পা হয়ে যেতেন। ঘনিষ্ঠ আমলা জগৎ মেহতা লিখেছেন, নেহরু বকাঝকাও করতেন প্রতিবাদীকে। দু’চার দিন পর আস্তে আস্তে মেনে নিতেন, কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। ইন্দিরা গাঁধী ছিলেন আর এক রকম। ইন্দিরার অন্যতম উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ পৃথ্বীনাথ ধর লিখছেন, ইন্দিরা কোনও বিষয়ে মন স্থির করার আগে অনেকের পরামর্শ নিতেন। প্রশ্ন করে জেনে নিতেন খুঁটিনাটি। কিন্তু এক বার সিদ্ধান্ত নিলে আর কারও কথাই শুনতেন না।

Advertisement

নরেন্দ্র মোদী যে কার পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেন, এবং কার সমালোচনায় কর্ণপাত করেন, দেশবাসীর কাছে তা এক রহস্য। মোদী সরকার কোনও নীতি (পলিসি) গ্রহণের আগে সেটি নিয়ে একটা উচ্চমানের, পরিশীলিত আলোচনা হয়েছে, এমন চোখে পড়ে না। যেটুকু জানা যায়, তিনি ২০১৫ সালে এক বার উচ্চপদস্থ আমলাদের থেকে উন্নয়ন সম্পর্কে কিছু প্রস্তাব চেয়েছিলেন। যে সব চিন্তা উঠে আসে, তার মধ্যে মোদীর পছন্দ হয় বিবিধ সরকারি সহায়তা সরাসরি ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে পাঠানোর প্রস্তাব। আন্দাজ করা যায়, পুরনো ও জটিল ব্যবস্থাকে সরল, কার্যকর, স্বচ্ছ করার প্রতি মোদীর একটা আগ্রহ আছে। যদিও এই ধরনের সমাধান ‘টেকনক্র্যাটিক’, প্রযুক্তি ও প্রশাসন-নির্ভর। গণতন্ত্রে নানা পক্ষের মধ্যে যে মত বিনিময় হওয়ার কথা, একে তেমন ‘ডেমোক্র্যাটিক ডিসকোর্স’ বললে অতিকথন হবে।

সরাসরি ব্যাঙ্কে টাকা পাঠানোর যে ব্যবস্থা মোদী করলেন, তা খানিকটা কাজেও দিচ্ছে। জনধন প্রকল্পে বহু মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলেছে বলেই আজ দিল্লির সরকার বিধবা পেনশন পাঠাচ্ছে মহিলাদের অ্যাকাউন্টে। জনধন প্রকল্প যে সর্বস্তরের মানুষের দৈনন্দিন লেনদেনকে ব্যাঙ্কের আওতায় আনতে পেরেছে, তা অবশ্য নয়। বহু অ্যাকাউন্ট অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে। তবে অন্তত পরিকাঠামো তৈরি হয়ে রইল। যদি ভবিষ্যতে নানা ধরনের সরকারি সহায়তার অর্থমূল্য ব্যাঙ্কে ঢোকে, তখন কাজে লাগবে। ইতিমধ্যেই যা ভাল ফল দিয়েছে, তা হল রান্নার গ্যাসের দামে ভর্তুকি হটিয়ে, ভর্তুকির টাকা গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে দেওয়া। এতে দুর্নীতি অনেক কমেছে। তবে সারের উপর ভর্তুকি এ ভাবে চাষির ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে পাঠাতে চেয়েও পারেনি সরকার। সে কাজটা বাকি রয়েই গিয়েছে।

Advertisement

কিন্তু নোট বাতিল? মোদীর দাবি ছিল, এতে কালো টাকা কমবে। অথচ দু’হাজার টাকার নোট চালু থাকলে কী করে তা সম্ভব, যদি না কয়েক মাস অন্তর নোট বাতিল করা হয়? সরকারের আর একটা যুক্তি ছিল, নোট বাতিল করলে আরও অনেক মানুষ ডিজিটাল উপায়ে লেনদেন শুরু করবেন। মূলস্রোতের অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হবেন। সে সম্ভাবনা আছে বইকি। ব্রাজ়িলে লেনদেনের একটি অ্যাপ ‘এমপেসা’ (ভারতের ‘পেটিএম’-এর মতো) চালু হয়েছে। গবেষকরা দাবি করেছেন, এর ফলে নাকি ব্রাজ়িলের জনসংখ্যার দুই শতাংশকে তুলে আনা গিয়েছে দারিদ্ররেখার উপরে। এটা একটা ভাল সম্ভাবনা নিশ্চয়ই। আপত্তি একটাই, ভারতে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ানোর জন্য নোট বাতিলের মতো সর্বনেশে নীতির প্রয়োজন ছিল না।

এটা বোঝা খুব কঠিন নয় যে, হাতে কম টাকা থাকলে লোকে কম খরচ করবে। জিনিস কিনলেও দাম মেটাতে পারবে না। ফলে বাজার সঙ্কুচিত হবে। মোদীর নোট বাতিলের ফলে তা-ই হয়েছে। যাঁরা আশা করেছিলেন, গোড়ায় কষ্ট হলেও আখেরে দেশের লাভ হবে, যাঁরা বিনাপ্রশ্নে মোদীর আশ্বাসে আস্থা রেখেছিলেন, তাঁরা এত দিনে নিজেদের ভুল বুঝেছেন। মন্দ অর্থনীতি দেশের মন্দই করে।

আর একটি ভ্রান্তিকে মোদী সরকার সাফল্য বলে চালাচ্ছে। তা হল মূল্যস্ফীতির হার কমানো। সরকার দাবি করছে, তারা দশ শতাংশ থেকে চার শতাংশে কমিয়ে এনেছে মূল্যস্ফীতি। ঠিকই, কিন্তু তার মূল্য দিয়েছেন কারা? ফসলের সহায়ক মূল্য বাড়ার সঙ্গে খাদ্যের মূল্যস্ফীতির সম্পর্ক খুবই স্পষ্ট এবং সরল। মূল্যস্ফীতি কমানোর যে নীতি সরকার নিয়েছে, তার সাক্ষাৎ ফল হল আজকের কৃষিসঙ্কট। খাবারের দাম কম রাখতে সরকার রফতানি নিয়ন্ত্রণ করেছে, আর প্রচুর আমদানিও করেছে। ২০১৬ সালে দেশে অতিরিক্ত ডাল উৎপাদন সত্ত্বেও সরকার ষাট লক্ষ টন ডাল আমদানি করেছিল। ফলে চাষির ফসল বাজারে দাম পায়নি। মূল্যস্ফীতি কমাতে চাষির স্বার্থ বলি দিয়েছে মোদী সরকার।

চাষিদের যা সুরক্ষিত করতে পারত, সেই প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনাও কাজে লাগেনি। ইঙ্গিত মিলছে, ফসলের ক্ষতি মাপার পদ্ধতি এখনও আদ্যিকালের— তা সম্পূর্ণ কর্মী-নির্ভর, অথচ কৃষি দফতর বা বিমা কোম্পানিরা যথেষ্ট কর্মী নিচ্ছে না। রাজ্যগুলো তাদের প্রদেয় অংশের ভর্তুকিও দিচ্ছে না। ফলে অতি বিলম্বে অতি সামান্য ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন চাষি, অথবা পাচ্ছেনই না। এমন যে হতে পারে, তা আন্দাজ করা কি কঠিন ছিল? আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে স্বাস্থ্যবিমার অংশটিও কার্যকর হওয়া যে কঠিন হবে, তার অন্যতম কারণও তাই। যথেষ্ট কর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা হয়নি। বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা ও তার চিকিৎসার কোনটার কত ব্যয় ধার্য হবে, ‘ক্লেম’ হলে খতিয়ে দেখতেই বা কত কর্মী লাগবে, তা কি স্থির হয়েছে? পরিকাঠামো তৈরি না করেই কী করে একটা নীতি চালু করে দেওয়া যায়? ক্ষতিপূরণের দাবি মেটানোর ব্যবস্থা ঠিকমতো কাজ না করলে অফুরন্ত চুরির সুযোগ তৈরি হয়।

সরকারি টাকার অত্যধিক ব্যয়ের জন্য রাজস্থানে সরকারি স্বাস্থ্য বিমার প্রকল্প ‘আরএসবিওয়াই’ বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।

অথচ চাষির জন্য সরকার বিমা করতে পারত রোজগারের ভিত্তিতে (আর্নিংস ইনশিয়োরেন্স)। বিশ্বের বাজারে কোনও ফসলের দর পড়লেই, দেশে যে চাষিরা সেই ফসল চাষ করেছেন তাঁরা ক্ষতিপূরণ পেতেন বিমা কোম্পানি থেকে। এর জন্য ফসলের ক্ষতি মাপার দরকারই হত না। চাষিও নিজের আগ্রহে বিমা করাতেন।

আসলে এই ধরনের সংস্কার করতে গেলে প্রয়োজন কিছু উৎকৃষ্ট অর্থনীতিবিদ, যাঁরা নতুন নীতির খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখবেন, নানা দিক থেকে তা নিয়ে চর্চা করবেন। কিন্তু মোদী সরকারের সঙ্গে অর্থনীতির বিশেষজ্ঞদের অহি-নকুল সম্পর্ক। রঘুরাম রাজন, অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যন, অরবিন্দ পানাগড়িয়া, উর্জিত পটেল, সকলেই সরে গিয়েছেন।

আর প্রয়োজন এমন কিছু নিবেদিত মন্ত্রী, যাঁরা দীর্ঘ দিন একটি নীতির রূপদান ও রূপায়ণ নিয়ে পড়ে থাকবেন। চিন্তা করার এবং লেগে থাকার ক্ষমতা যাঁদের আছে। দুর্ভাগ্য, নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভায় এমন মন্ত্রী নেই। কেবল পিএমও-র আধিকারিকদের দিয়ে এ সব সংস্কার সম্ভব নয়। হয়তো রমন সিংহ কিংবা শিবরাজ সিংহ চৌহানদের মতো অভিজ্ঞ মুখ্যমন্ত্রীরা এ বিষয়ে মোদীর সহায়ক হতে পারতেন। কিন্তু মোদী সম্পর্কে এ কথাও এত দিনে স্পষ্ট হয়েছে যে, অন্য কোনও জনপ্রিয় নেতার উপর আস্থা রাখেন না তিনি।

ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনলজিতে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন