ছবি টুইটার থেকে।
আমেরিকা সফর শেষ। মার্কিন মুলুক ছেড়ে ইজরায়েল চলে গিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু ট্রাম্পের দেশের মাটি থেকে পা তুলে নেওয়ার আগে নরেন্দ্র মোদী বুক ভরে যে পরিতৃপ্তির শ্বাস নিয়েছেন, তা নিয়ে সংশয় থাকার কথা নয়।
তৃপ্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির চলতি হাওয়াটা যে রকম, তাতে ভারত-মার্কিন অক্ষের সুদৃ়ঢ় এবং উজ্জ্বল উপস্থিতি দৃশ্যমান হওয়া দু’দেশের জন্যই সম্ভবত জরুরি। নরেন্দ্র মোদীর ভারত সেই জরুরি কাজটা করতে উৎসাহী ছিল ঠিকই। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা উৎসাহী কতটা, তা নিয়ে সংশয় পৃথিবীর নানা প্রান্তেই বিস্তর ছিল। সর্বাগ্রে আমেরিকা— স্লোগান দিচ্ছেন ট্রাম্প। কিন্তু আমেরিকাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সর্বাগ্রগণ্য রাখতে যা কিছু করা জরুরি, সেই সব কিছু করতে ট্রাম্প যে প্রস্তুত নন, অনেক ক্ষেত্রেই যে একবগ্গা উল্টো অবস্থানই ট্রাম্পের পছন্দ, সে বেশ স্পষ্ট আজ। তাই নিবিড় ভারত-মার্কিন সম্পর্কের জন্য জরুরি যা কিছু, ট্রাম্প সেই সব কিছুকেই জরুরি মনে করবেন, এমন নিশ্চয়তা ছিল না। নরেন্দ্র মোদী নিশ্চয়তা আদায় করে নিলেন। মোদীর এই আমেরিকা সফরে নয়াদিল্লি এবং ওয়াশিংটন যে যে বিষয়ে একমত হল এবং যে সব যৌথ পদক্ষেপ করল, তাতে আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক মঞ্চে ভারতের অবস্থান আগের চেয়েও মজবুত হল।
যে কোনও আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের জন্য অস্বস্তির কাঁটা হয়ে যে দুই দেশ প্রায় সব সময় খচখচ করে, তারা চিন এবং পাকিস্তান। দীর্ঘ-দীর্ঘ সময় ভারতকে প্রায় একা যুঝতে হয়েছে এই চিন-পাকিস্তান অক্ষের বিরুদ্ধে। বেশ কয়েকটা দশক ধরে আমেরিকা এবং চিনকে একযোগে পাশে পেয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। সন্ত্রাসবাদের শিকার হওয়ার পর থেকে আমেরিকা উপলব্ধি করেছে, পাকিস্তান গোটা বিশ্বের সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী বিশ্বে চিন নিজেদেরকে আমেরিকার উপযুক্ত প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করায়, বেজিংকেও উপযুক্ত বার্তা দিতে তৎপর ওয়াশিংটন ডিসি। এশিয়া-প্যাসিফিকের সীমা ছাড়িয়ে গোটা পৃথিবীতে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে সচেষ্ট চিনকে রোখা, পাকিস্তানকে সন্ত্রাস নির্মূল করতে বাধ্য করা, এই যদি লক্ষ্য হয় আমেরিকার, তা হলে ভারত এবং আমেরিকা অনেকাংশেই পরস্পরের স্বার্থের পরিপূরক। সেই কারণেই কাছাকাছি আসা দুই শক্তির। সেই কারণেই অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক সহযোগিতা দ্রুত বৃদ্ধির পথ নেওয়া। সেই কারণেই গত এক দশক বা তারও একটু বেশি সময় ধরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ক্রমশ নিবিড় করা।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলেই সবচেয়ে বেশি উচ্চতায় পৌঁছেছিল ভারত-মার্কিন সম্পর্ক। ট্রাম্প যুগের সূচনায় তা আরও উত্তুঙ্গ হবে, নাকি থমকে যাবে? এ প্রশ্নের খুব স্পষ্ট জবাব কারও কাছেই ছিল না। হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প এবং মোদীর বৈঠকের পর সে প্রশ্নের জবাব খুব স্পষ্ট ভাবেই মিলল। অনেক শিবিরে অনেক উৎকন্ঠারও অবসান হল। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যৌথ লড়াই আগেই শুরু করেছিল ভারত-আমেরিকা। কিন্তু সেই লক্ষ্যে সহযোগিতা আরও নিবিড় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দু’দেশ। পাকিস্তানের অবৈধ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন পূর্ববর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্টও। বর্তমান প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে পাকিস্তানের প্রতি বার্তাটা কঠোরতর হল, আরও শাণিত হল। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনা নৌসেনার প্রভাব বৃদ্ধির পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে ভারত, আমেরিকা এবং আমেরিকার সহযোগী দেশগুলির নৌসেনার মধ্যে সমন্বয় আরও অনেক বাড়তে চলেছে বলেও ইঙ্গিত মিলল। অর্থাৎ ট্রাম্প-মোদী বুঝিয়ে দিলেন, পাকিস্তানি সন্ত্রাস আর চিনা সামরিক আস্ফালন, এই দুই সঙ্কটের বিরুদ্ধেই যৌথ পদক্ষেপ হবে এবং আগের চেয়েও মজবুত ভঙ্গিতে হবে। এ বারের আমেরিকা সফর থেকে এর চেয়ে বেশি কী-ই বা কাম্য ছিল নরেন্দ্র মোদীর?
ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার আগে উৎকণ্ঠা বিন্দুমাত্র ছিল না, এ কথা নরেন্দ্র মোদী নিজেও সম্ভবত দাবি করবেন না। আমেরিকার সর্বোচ্চ প্রশাসক হওয়ার পর ট্রাম্প এমন অনেক দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছেন, যাদের সঙ্গে আমেরিকার নিবিড় মিত্রতা বহু দশকের। এ হেন ট্রাম্প ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের অগ্রগতির প্রতি তাঁর পূর্বসূরিদের মতোই দায়বদ্ধ থাকবেন, সে নিশ্চয়তা ছিল না। ওবামার একাধিক নীতিকে ইতিমধ্যেই আবর্জনার স্তূপে পাঠিয়ে দেওয়া ট্রাম্প যদি ওবামার ভারত-নীতিরও সেই হাল করতেন, দায় কিন্তু চাপত নরেন্দ্র মোদীদের ঘাড়েই। মোদীর আমলে ভারত আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে বলে বিরোধী দলগুলি বার বার অভিযোগ করে আসছিল। তাই ট্রাম্প ‘নিজ গুণে’ বেঁকে বসলেও, দায় মোদীরই হত। অতএব, ঘরে-বাইরে সমপরিমাণ চাপ সঙ্গী করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মুখোমুখি হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। হয়তো উৎকণ্ঠা নিয়েই পা রেখেছিলেন ওভাল অফিসে। বেরিয়ে এলেন কিন্তু চওড়া হাসি নিয়ে। আমেরিকা সফর থেকে নিঃসন্দেহেই অনেক কিছু নিয়ে ফিরছেন তিনি।