সাধককবি রামপ্রসাদ সেন মধ্যযুগের অন্তিমে অবক্ষয়িত সমাজজীবনের ঘাতপ্রতিঘাতে বিধ্বস্ত হয়ে তাঁর উপাস্য দেবীর কাছে ব্যাকুল প্রার্থনা জানিয়ে নিজের উত্তরণের পথ খুঁজতে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী’। প্রায় এক শতাব্দী পরে নবজাগরণের বহুমুখী ব্যাপ্তির কালে নিজের জন্য নয়, আত্মবিশ্বাসহীন পরপদানত গণজীবনে চৈতন্যের জাগরণের জন্য আকুল আহ্বান জানিয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। সমকালীন জীবনায়নে এই চৈতন্যের অভাব প্রবল পীড়িত করেছে তাঁকে। সচেতনতার অভাব থেকেই দেখা দেয় বেহিসাবি অন্যায়-অত্যাচার-অনাচার। এই সঙ্গেই অহমিকা-বাগাড়ম্বর-নীতিহীনতা হয়ে উঠেছিল গগনচুম্বী। তাই কাছের দূরের সবার চৈতন্যের জাগরণের উপর তাঁর গুরুত্ব আরোপ, যা আজকের ব্যক্তি ও সমাজজীবনের প্রেক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শ্রীরামকৃষ্ণ বারংবার সর্বজন মাঝে জীবনের উদ্দেশ্যরূপে ঈশ্বরলাভের কথা বলেছেন। এই ঈশ্বরলাভ আসলে আত্মজ্ঞান লাভ, যা চৈতন্যেরই নামান্তর। এই আত্মজ্ঞানের অধিকারী হলে মানুষের জীবন সুস্থ ও সুন্দর হয়ে ওঠে। নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে জগৎ জীবনের সংযুক্তিতে, সংশ্লেষণে যথার্থ সচেতনতার আলোয় দাঁড়িয়ে মানুষ উদার ও মহৎ হয়ে উঠতে পারে। পারে তার অস্তিত্বের অন্দরে আনন্দঘন দৃষ্টির সম্প্রসার ঘটাতে। মানুষের মধ্যে তখনই ‘আত্মদীপো ভব’ বাস্তবায়িত হয়। নিজের মধ্যে, অপরের মধ্যে, সর্বোপরি সকলের মধ্যে আলো জ্বলে ওঠে। ‘কাঁচা আমি’র অন্ধকার সরে যায়, জেগে ওঠে ‘বড় আমি’। ‘ছোট আমি’র আবরণ খসে গিয়ে ধরা দেয় ‘বড় আমি’। সোক্রাতেসের ভাষায় ‘রিলেটিভ ট্রুথ’-এর উপর প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইটারনাল ট্রুথ’। এর বিহনে সহিষ্ণুতার অভাব, সহনশীলতার অভাব প্রকট হয়— ব্যক্তিজীবন তো বটেই— সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনেও, যা অনেকাংশেই খর্ব করে মানবতাকে।
অহেতুক দ্বন্দ্ব সংঘাতের মূলে প্রধান হয়ে ওঠে আমিত্ব। শুধুই ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা। কুয়োর ব্যাং ও সমুদ্রের ব্যাঙের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি বোঝান যে, সংকীর্ণ কুয়োর ব্যাং জানেই না, সমুদ্র কত বড়! তবু তার আস্ফালন কমে না। তেমনই সংকীর্ণ মনোভাবের মানুষজন বৃহত্তর জীবনবোধ-ধর্মবোধের হদিশ পায় না। সমুদ্রের পাড়ে বসেও তাই কূপ খনন চলে তাদের, অধরাই থাকে ভূমা-বৃহৎ। ‘মান’ ও ‘হুঁশ’-এর সংযুক্তিতে যে বৃহত্তর মানবচেতনা, সেটিই দেশকালের প্রেক্ষিতে একান্ত অভিপ্রেত-অভীপ্সিত। অথচ আমরা তা বুঝেও বুঝি না। এটিই আক্ষেপের, দুঃখের।
সকলের সঙ্গে সহজ সারল্যে মেলামেশা-ভাববিনিময়ের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ শ্রীরামকৃষ্ণ কৈশোরে ও প্রথম যৌবনে যে অনাড়ম্বর, নিরহংকারী আন্তরিক ভালবাসা জড়ানো জীবনছন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন, কলকাতা তথা দক্ষিণেশ্বরের বুকে তাতে ভর করেই তাঁর যাপনচিত্রের রূপরেখাটি আমাদের সামনে নানা ভাবে উন্মোচিত। ভক্তদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলেছেন, নিজে গান করেছেন, গান শুনেছেন বিহ্বল হয়ে— ভগবৎপ্রসঙ্গকে টেনে নিয়ে গেছেন মনের নিভৃত নিলয়ে। একান্ত অনুভবের মণিমানিক্য সংযুক্ত করে সর্বজনগ্রাহ্য করে উপস্থাপিত করেছেন। কী নেই সেখানে? আছে প্রেম-ভক্তি-প্রীতি-সেবা-জ্ঞান-বিজ্ঞান-নিত্য-অনিত্য— সব কিছুই। তা সমাজ-সংসার বিযুক্ত নয়, আশ্চর্য এটিই। উপমা কত রূপক— সবই এই জগৎ-জীবন আশ্রয়ী।
সীমাসংহত জীবনের মধ্যেও যে অনন্তের আস্বাদ আছে তা তাঁর মতো করে কে-ই বা বলেছেন। সমাজের বিশিষ্ট জনেরা ছুটে এসেছেন, তাঁর কাছে সেই সব কথা শুনবেন বলে। অহংকারের লেশ তাঁকে স্পর্শ করেনি। তিনিও গেছেন তাঁদের কাছে। কখনও আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে কখনও বা ব্যাকুল প্রাণের টানে। আন্তরিক ভাবে সকলকে গ্রহণ করার এই দৃষ্টান্তে চূর্ণ হয়েছে ক্ষুদ্র অস্মিতার ঘেরাটোপে আবদ্ধ মানুষের জীবনবোধ। পণ্ডিত-জ্ঞানী হলেই হবে না, মনকে উদার করতে হবে, বৃহৎ সমাজজীবনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে হবে, সংকীর্ণ স্বার্থপরতার গণ্ডি থেকে মুক্ত হয়ে।
সতীদাহের সময়পর্ব থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত নারীদের উপর তীব্র অত্যাচারের বিভিন্ন প্রকাশ দেখি প্রতিনিয়ত। এ-ক্ষেত্রে, মানুষের হৃদয়ে মাতৃভাবের অভাবকেই তিনি তাঁর সেই সময়পর্বে চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন, মাতৃভাব সর্বাপেক্ষা শুদ্ধভাব। সহধর্মিণী সারদাদেবীকে ষোড়শী রূপে পূজা নিবেদনের মধ্যে দীর্ঘ অবহেলিত নারীশক্তির উন্মোচন ঘটিয়েছেন তিনি, যাঁর হাতে সমর্পিত হয়েছিল রামকৃষ্ণ সংঘের গুরুদায়িত্ব। নারীকে মাতৃশক্তির অংশ রূপে জ্ঞান না করে ভোগের সামগ্রী রূপে দেখা ও ভাবার ফলেই সাম্প্রতিক জীবনে এত রিরংসা, বিকৃত কামনাবাসনার উদগ্র প্রকাশ। শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষা প্রয়োগ করলে আমরা এই তমসা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাব।