প্রতিবন্ধীদের আর কত অবহেলা

প্রত্যকে বছরের মতো এ বারেও ৩ ডিসেম্বর  পালিত হল আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। সারা বিশ্বের সঙ্গে এ রাজ্যেও দিনটি উদ্‌যাপিত হল। কিন্তু উৎসব-উদ্‌যাপন পেরিয়ে থেকে যায় সেই চিরন্তন প্রশ্ন

Advertisement

বুবাই বাগ

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

প্রত্যকে বছরের মতো এ বারেও ৩ ডিসেম্বর পালিত হল আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। সারা বিশ্বের সঙ্গে এ রাজ্যেও দিনটি উদ্‌যাপিত হল। কিন্তু উৎসব-উদ্‌যাপন পেরিয়ে থেকে যায় সেই চিরন্তন প্রশ্ন: প্রতিবন্ধী মানুষদের অবস্থার কি সত্যিই কোনও পরিবর্তন ঘটেছে আমাদের চার পাশে?

Advertisement

গত বছরের মতো এ বারেও ২০১৬ সালের প্রতিবন্ধী মানুষ অধিকার আইনের বাস্তবায়নের দাবি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের প্রতিবন্ধকতার অধিকার সম্পর্কিত সংগঠন ও বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন একাধিক মিটিং-মিছিলের আয়োজন করে। উল্লেখ করতেই হয়, সারা দেশের মধ্যে বৃহত্তম সমাবেশটি দেখা গিয়েছিল কলকাতার রাজপথে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর উদ্যোগে। গত ২৫ বছর ধরে এই উদ্যোগ চলে আসছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও না বলে উপায় নেই, পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের প্রতিবন্ধকতা বিষয়ক ভাবনা ডিসেম্বর মাসের প্রথম কয়েক দিনেই সীমাবদ্ধ থাকে।

এখনও পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের এমন কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে প্রতিবন্ধী মানুষেরা বিনা বাধায় সম্পূর্ণ অংশগ্রহণ করতে পারেন। আজও পশ্চিমবঙ্গে বাস, ট্রাম, ট্রেন বা পরিবহণের এমন কোনও মাধ্যম নেই, যেখানে এক জন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী অনায়াসে যাতায়াতের সুযোগ লাভ করতে পারেন, এবং নিজেকে অন্যদের সমান মনে করতে পারেন। প্রতিবন্ধী মানুষদের পক্ষে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের বাতাবরণ তৈরি করে তাঁদের অধিকার রক্ষার তেমন প্রয়াস এখনও পর্যন্ত দেখা গেল না। অথচ সমান সুযোগ, সম্পূর্ণ অংশগ্রহণ এবং অধিকার রক্ষার বিষয়গুলি তো ১৯৯৫ সালের প্রতিবন্ধকতা আইনেই উল্লিখিত ছিল।

Advertisement

সেই আইনের বাস্তবায়নের আগেই ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে পাশ হয় প্রতিবন্ধী মানুষ অধিকার আইন। ২০০৬ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ‘অধিকার বিষয়ক সনদ’-এ স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত প্রতিবন্ধীদের জন্য নতুন আইন প্রণয়নে দায়বদ্ধ ছিল। সেই অঙ্গীকার রক্ষার উদ্যোগ শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে। ২০১৬ সালের আইনটি প্রণীত হয় তার ফলেই। পাঁচ বছর ধরে আইনের খসড়া নিয়ে আলোচনার পর সংসদের উভয় কক্ষে আইনটি পাশ হয়ে যায় এক দিনেই।

প্রতিবন্ধকতা বিষয়ক চেতনার এই অবস্থার কারণ কী? প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা খুব কম নয়। ২০১১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সাত ধরনের (১৯৯৫ সালের আইন মোতাবেক) প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, ভারতে এমন মানুষদের সংখ্যা ২.২৬%। যদি ২০১৬ সালের আইন মোতাবেক ২১ ধরনের প্রতিবন্ধকতাকে ধরা হয়, তা অনায়াসেই ১০ শতাংশ অতিক্রম করবে। ২০১১ সালের জনশুমারি মোতাবেক পশ্চিমবঙ্গেও প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বিশ লক্ষাধিক। তা সত্ত্বেও তাঁদের অবস্থার পরিবর্তনে গত এক বছরের উদ্যোগ বলতে কেবল ‘মানবিক’ পেনশন বা অনুদানের ব্যবস্থা। প্রশাসনিক স্তরে এই ধরনের অবহেলা কেন? এটা ঠিক যে ভৌগোলিক বিভাজন এবং উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে প্রতিবন্ধীরা এখনও শাসক বা বিরোধী কোনও দলের কাছে ভোট রাজনীতির অঙ্গ হয়ে উঠতে পারেননি। ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে আকর্ষক নন বলেই কি তাঁরা আজও অবহেলিত?

ভোট রাজনীতির অঙ্গ হয়ে উঠতে না পারা রাজনৈতিক দলের অবহেলার কারণ, এমন কথা তর্কের খাতিরে মেনে নিলেও, রাজনৈতিক সমাজের বাইরে যে নাগরিক সমাজ, তার নেতিবাচক মানসিকতার কারণটা অনুসন্ধান করাটা জরুরি। প্রতিবন্ধকতার মতো বিষয় এখনও পর্যন্ত মূলস্রোতের অ্যাকাডেমিক চর্চায় প্রবেশ করেনি। যদিও ২০০৫ সালে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক দেশের সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘প্রতিবন্ধকতা বিষয়ক চর্চা’ পাঠ্য করার সুপারিশ করেছিল, সেই বিষয়ে কোনও উদ্যোগ বা সদিচ্ছা দেখা যায়নি। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধীদের উপযোগী পরিকাঠামো (র‌্যাম্প, লিফট ও প্রতিবন্ধী-বান্ধব শৌচালয়) সীমিত। শিক্ষাপরিসরে অন্তর্ভুক্ত হতে না পারায় প্রতিবন্ধীদের আর্থিক স্বনির্ভরতা অর্জনের ক্ষেত্রেও সমস্যা প্রভূত।

২০১৮ সালের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসের মূল ভাবনা ছিল ‘প্রতিবন্ধীদের ক্ষমতায়ন এবং অন্তর্ভুক্তিকরণে সাম্য বা সমতার নিশ্চিতিসাধন’। সেই চেতনার সার্থক রূপায়ণ ঘটাতে পারে ২০১৬ সালের প্রতিবন্ধী মানুষ অধিকার আইন। তবে সেখানে সর্বস্তরের প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণে সহায়তার নৈতিক দায়িত্ব পালনে রাজ্য প্রশাসনকে অগ্রণী হতে হবে। লক্ষণীয়, প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি অনেকাংশে রাজ্য তালিকাভুক্ত। অনুদান বা পেনশন প্রতিবন্ধী মানুষদের বেঁচে থাকার শেষ রসদ হতে পারে, কিন্তু তার পরিবর্তে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করার উপযুক্ত পরিকাঠামো নির্মাণে প্রশাসনের ‘মানবিক’ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ আবশ্যক। গত পঞ্চাশ বছরে সমগ্র বিশ্বে প্রতিবন্ধী মানুষদের ‘দয়া বা করুণা নির্ভর সমাজ’ থেকে ‘অধিকার নির্ভর সমাজ’-এ উত্তরণ ঘটে গিয়েছে, এই সত্যকে তো আর অস্বীকার করা যায় না।

বাগনান কলেজে ইতিহাসের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন