ছবি: সুমন চৌধুরী
কথা হল, ‘অ্যাঁ! ছেলে হয়ে মা-কে মারল!’ আইএস যেখানে ইচ্ছে করলেই অন্য কাউকে দিয়ে মৃত্যুদণ্ডটা কার্যকর করাতে পারত, সেখানে এ রকম করল কেন? আসলে, অপরিণত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী খুব নাটক ভালবাসে। বাঙালি পরিবারে যেমন এক জন না এক জন কাকু বা মাসি থাকে, যে জ্বর হলেই মৃগীমুর্গির মতো সশব্দ কোঁকায়, বা কলেজে লেঙ্গি খেলে দু’বছর হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকে, ফুচকা খায় না। এই নাটুকেপনাকে বাঙালি খুব মূল্য দেয়। যুক্তির চেয়ে অনেক ওপরের তাক-এ রেখে পুজো করে। আইএস-ও নাটকবাজিকে গুরুত্ব দিয়ে, ‘ছেলেই মাকে মারবে’ আদেশ দিল (মা’র নামে নালিশও ছেলেই করেছিল)। এটার একটা পটাং-অ্যাপিল আছে। দেখেছ, আমরা এমন ক্যাডার তৈরি করি, সে সুপার-আনুগত্যে এমনকী মা’কেও খুন করতে দ্বিধা করে না! সত্যিই, এই ঘচাং-ফু হয়তো ছেলেটার টিআরপি বাড়াবে দলে, কেউ কেউ নিজস্ব খুন করতে যাওয়ার আগে তার চরণাম্মেতো খেয়ে যাবে! কিন্তু এই মা’কে খুন-টা সন্তানের জীবনে কোনও ট্রমা-র জন্ম দেবে কি না, মা’র শেষ চাউনি তাকে ঘুমের গহনে তাড়া করবে কি না, এর ফলে তার পরবর্তী ট্রিগারে আঙুল কেঁপে যেতে পারে কি না, সে জেহাদের ক্রিটিকাল মুহূর্তে অমনোযোগী হয়ে পড়তে পারে কি না, অতিজেহাদ দেখাতে গিয়ে সে আদতে এক পিস কম-জেহাদি হয়ে পড়ল কি না, এ সব আইএস ভাবেনি বোধহয়। কাজকম্ম দেখে, ওদের খুব তলিয়ে ভাবা পাবলিক বলেও মনে হয় না।
আবার ওরা এ রকমও ভাবতে পারে, এ লোকটা কাল থেকে গোল্লায় গেলে যাক, এই উদাহরণটা আমাদের সংগঠনের ইমেজটাকে বহু দূর নিয়ে যাবে। যে হেতু ‘মা’ ব্যাপারটাকে একটা সর্বজনীন তোল্লাই দেওয়া হয়, তাই কোটি কোটি জল্লাদগিরির খবরের মধ্যে থেকেও এটা আলাদা ঝটাস-থাপ্পড় হিসেবে বিশ্বে আছড়াবে, এবং আমরা বোঝাতে পারব আমাদের মগজ-ধোলাই কী সার্বিক ও নিঃশর্ত, এ চেতাবনিও পৌঁছবে: কোনও তুমুল ব্যক্তিগত সম্পর্ককেও কাজে লাগিয়ে আমাদের সাবোতাজ করা না-মুমকিন। আর, গোটা বিশ্বই আল্টিমেটলি নাইট্য-ক্যাংলা, সে চুপচাপ যাথাযথ্যের চেয়ে চটকদার ডিসপ্লে-কে চিরকাল অধিক মূল্য উপুড় করেছে, তা হলে সে প্রবণতাটা ব্যবহার করে কেনই বা আমাদের সংগঠন নিয়ে একটা এক্সএক্সএল হেডলাইন আদায় করব না? সে দিক থেকে দেখলে, ওদের প্ল্যান সফল। এবং সত্যিই তো, এক জন ব্যক্তি-জেহাদির চেয়ে, এক খণ্ড মিথ অনেক বেশি জরুরি, আন্দোলনের পক্ষে। তা হলে অবশ্য মানতে হবে, ওরা তলিয়েই ভাবে।
এ বার আসল ব্যাপার। ‘মাদার ইন্ডিয়া’র শেষে নারগিস নিজের ছেলেকে গুলি করে মারেন। দর্শক দুঃখ পায়, কিন্তু তার পূর্ণ সমর্থন থাকে মায়ের দিকে। কারণ, ছেলে যদি ‘ঠিক রাস্তা’ থেকে চ্যুত হয়, তা হলে তো মা’কে শেষ সমাধান হিসেবে এটা বেছে নিতে হবেই, দেশ ও দশের জন্যে। ধরা যাক, আজ যদি সিদ্ধার্থ ধর তার লন্ডনের বাড়িতে উপস্থিত হয়, ‘মা, তোমার কোলে মাথা রেখে একটু শোব, কাল বিকেলে মেট্রোয় বোম রাখতে যাব, যাতে তিনশো লোক খুন হয়’, আর সবিতা ধর যদি সন্তানের মাথা কোলে নিয়ে হাতে সেলফোন তুলে পুলিশ ডেকে নেন, তা হলে আমরা তাঁকে শাবাশ দেব না কি? আমরা কি বলব না, সত্যি, এই হচ্ছেন এক জন মানুষের মতো মানুষ, যিনি, ছেলে মরবে বা সারা জীবন জেলে পচবে জেনেও তাকে ঠিক-শাস্তির দিকে ঠেলে দিয়েছেন, কারণ সাচ্চা মানুষের কাছে সন্তান বা প্রিয়জনের চেয়ে অনেক দামি হল ন্যায় ও স্বধর্ম? তা হলে, এই ছেলেটা যখন তার মা’কে মেরেছে, সে কিন্তু নিজধর্মে ঠিক থেকেছে। মা বলে তার হাত কাঁপেনি, সেটা তার চারিত্রিক অসামান্যতারই পরিচায়ক। ‘আদর্শের জন্য সব কিছুকেই ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনও মূল্যবোধের বশেই আদর্শকে ত্যাগ করা যায় না’ যদি কারও অস্তিত্বের মূল সুর হয়, সে তো শ্রেয় পথের পথিক। ঈশ্বর যদি কাউকে বলেন, তোমার একমাত্র ছেলেকে হত্যা করে আমার প্রতি ভক্তি প্রমাণ করো, আর সে যদি ছেলেকে পাহাড়ের চুড়োয় নিয়ে গিয়ে নিরপরাধ সন্তানের বুকের ডগায় অনুতাপহীন ছুরি তোলে, তাকে কি আমরা বারংবার পেন্নাম ঠুকি না?
নারগিসের আদর্শ ‘ঠিক আদর্শ’ আর আইএস-এর আদর্শ ‘ভুল-আদর্শ’, এ তর্ক করে কোনও লাভ নেই। সবার আদর্শই সবার কাছে ঠিক, এবং সেই মুহূর্তে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ঠিক। আমরা সবাই জানি, এখানে যে উগ্রপন্থী ওখানে সে-ই বিপ্লবী, আর আজকের ভিলেন কালকের শহিদ। বা উলটোটা। চে গেভারা গুচ্ছের লোককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। নিজের হাতে গুলিও করেছেন। তাই তাঁকে যারা ভুল-আন্দোলনকারী বলে মনে করেছে, তারা যখন তাঁকে খুন করছে, সেটায় পেল্লায় আঁতকে ওঠার কিছু নেই। তাতে আপনি কান্নাকাটি অবশ্যই করতে পারেন, কারণ আপনার সমর্থন চে-র আদর্শ, নীতি, কর্মপদ্ধতির প্রতি, কিন্তু ‘চে তো প্রতিবিপ্লবীদের মারছিলেন, পৃথিবীর ভাল করছিলেন, প্রতিবিপ্লবীরা কেন চে-কে মারল, ছি ছি’ বলাটা ঈষৎ ন্যাকামি হবে। প্রতিবিপ্লবীদের কাছে তো চে প্রতিবিপ্লবী! এ বার যদি বলেন, হত্যা মাত্রেই খারাপ, কোনও আদর্শের বশেই প্রাণ নেওয়া যায় না, তা হলে আবার অন্য বিপদ। যে নকশাল ছোকরাদের নিয়ে বাঙালি রোজ গরম-গরম অশ্রু ঝরাচ্ছে নস্টালজিক গালে, তাদেরও ছাড় দেওয়া যাবে না। এমনকী ক্ষুদিরামকেও অতি বদ লোক ভাবতে হবে। বা সূর্য সেন-কে। অত্যাচারী সাহেব মারলে মানুষকে মারা হল না, তা তো হতে পারে না। আসল কথা হল, আমরা যাদের ভাল ভাবি, তারা মানুষ মারলে বীরের আখ্যা দিই। পাঠানকোটে তাই যে সামরিক ব্যক্তিরা মারা গেছেন তাঁরা শহিদ, আর যাদের মেরেছেন তারা উগ্রপন্থী। বর্ডারের ও-দিকে হয়তো উলটো মত। সেখানে অন্য সর্বনামে ‘ওঁদের’ লেখা হচ্ছে আর ভারতীয়দের ক্ষেত্রে চন্দ্রবিন্দুটা সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
হ্যাঁ, এই ছেলেটির মা ওদের সংগঠনের গোপন খবরও কোথাও পাচার করে দিচ্ছিলেন না, শত্রুসেনাকে পাঁউরুটিও জোগাচ্ছিলেন না। তাই প্রত্যক্ষ ভাবে তিনি আইএস-এর আদৌ সর্বনাশ করছিলেন না। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, তিনি ছেলেকে তার সাধনা থেকে চ্যুত করতে চাইছিলেন। নিজের লক্ষ্যের প্রতি চূড়ান্ত দায়বদ্ধতা বলে: তোমার পথে এতটুকু বাধাও তুমি সহ্য করবে না। গার্সিয়া মার্কেস যখন ‘হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচুড’-এর ধারণা-বীজটা মাথায় নিয়ে দোর দিয়েছিলেন, আর স্ত্রীকে বলেছিলেন ‘যদ্দিন না উপন্যাসটা শেষ হচ্ছে আমি ঘর থেকে বেরোব না, সংসার কী ভাবে চলবে তুমি বুঝে নিয়ো’, তখন সেটা ছিল অমানবিক একটা কাজ। ঠিকঠাক ফেমিনিস্টের তো উচিত গার্সিয়া মার্কেসকে ধুয়ে কাপড় পরিয়ে দেওয়া, কারণ স্ত্রীকে অভাবনীয় আর্থিক বিপদে ফেলে তিনি শিল্প-মৃগয়া ফলাচ্ছেন, এবং বোঝাচ্ছেন, তাঁর কোটর-আহ্বান স্ত্রীর স্বচ্ছন্দ অস্তিত্বের চেয়ে বেশি জরুরি। হ্যাঁ, উপন্যাসটা পরে বিশ্বখ্যাত হয়েছে, তাই এ কাণ্ডটা গার্সিয়া মার্কেসের শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা বলে কীর্তিত হচ্ছে। যদি উনি উপন্যাস শেষ করতে বারো বছর লাগাতেন এবং বই সাড়ে পনেরো কপি বিক্কিরি হত আর সংসার ভেসে যেত, তখন হঠকারিতা বলা হত। কিন্তু আমরা যুগে যুগে তাঁদেরই পায়ে মাথা ঠেকিয়ে ধন্য হই, যাঁরা এই সব বাস্তবচিন্তায় মাথা না দিয়ে, স্বার্থপর, এমনকী হিংস্র আত্মনিবেদন নিয়ে নিজের ‘কাজ’-এ সাষ্টাঙ্গ ঝাঁপ দেন। তাতে অন্য কারও, এমনকী সবচেয়ে আপন কারও-ও, কী ক্ষতি হল তা দেখেন না। কার্ল মার্ক্স যদি দাস কাপিটাল-এর পিছনে ষোলো বছর না লেগে থেকে একটা ভদ্রস্থ চাকরি বাগাতেন, হয়তো তাঁর তিন তিনটে বাচ্চা মারা যেত না।
তার মানে কি এই: আপসহীন কাজ করতে গিয়ে দারিদ্রের চোটে আপনজনকে হারানো, আর নিজের মা’র মাথায় বুলেট ঠুকে দেওয়া একই ব্যাপার? মার্ক্স কি বাচ্চাদের হত্যা করেছিলেন? গার্সিয়া মার্কেস কি বউকে গুলি করেছিলেন? যে সাধক ঈশ্বরকে পাবেন ভেবে বউয়ের আঁচলের গেরো খুলে আর বৃদ্ধা মা’কে ফেলে রাত্রের অন্ধকারে উধাও হয়ে গেলেন, তাদের অশ্রু ও বুকফাটা আর্তনাদের পরোয়া করলেন না, তিনি কি ওদের খুন করলেন? কক্ষনও না। কিন্তু আমরা যেন এই মহান মানুষদের ‘যা-ই ঘটুক, তা যতই সর্বনাশা হোক, আমার কাছে আমার লক্ষ্যটাই অগ্রাধিকার পাবে, ব্যস’-এর মধ্যে নিহিত ‘হিংসা’-টা চিনতে শিখি এবং বুঝি, এরই চূড়ান্ত একটা রূপ হল, যে-লোকটা রোজ কাঁউকাঁউ করে আমায় আদর্শ থেকে ঠেলে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সাধনায় প্রাণপণ ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, তাকে এক কোপে শেষ করে দেওয়া।
কী বললেন? আইএস জঙ্গি তো কোনও মহান কাজ করেনি, তা হলে তাকে এঁদের সঙ্গে তুলনা কেন? আরে, এঁরা তো মহান হয়েছেন অনেক পরে। সিদ্ধান্তটা নেওয়ার সময় তো মহান ছিলেন না। এমনকী জানতেনও না, শেষ অবধি আদৌ মোক্ষ পাবেন কি না। শুধু ওঁদের একটা আন্দাজ ছিল, এই কাজটাই আমার জীবনের কেন্দ্র, আমার আঁধারমানিক, এবং এর জন্যে চলতি সব দায়িত্ববোধ ও আবেগবাঁধনকে লাথি মেরে, নিজের রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেই হবে। পরে, তাঁদের কীর্তি প্রমাণ করেছে, ওই অন্য-মানুষকে-কেয়ার-না-করা কাজগুলো পৃথিবীর উন্নতি ঘটিয়েছে, তাই আমরা মনে করেছি, ওঃ, তা হলে তো অন্য ব্যক্তিদের বেদনা-দান কোথাও একটা জাস্টিফায়েড। আমরা উলটো-চার্জ করিনি, ‘ভাই, তোমার প্রতিটি, প্রতিটি কাজের দায়িত্ব তোমায় নিতেই হবে, সে তুমি পিকাসো হও আর গৌতম বুদ্ধ। ও-সব বড়-লক্ষ্যের জন্য ছোট-ড্যামেজের গল্প, বৃহত্তর লাভের জন্য খুচরো কিছু মানুষের জীবন তছনছিয়ে দেওয়ার ক্ষুদ্রতর ক্ষতির তত্ত্ব আউড়ে, নীতির ঘরে চুরি চলবে না।’
ধরা যাক, আইএস যদি এক দিন সারা পৃথিবীকে অধিকার করে নেয় আর সব্বাইকে তাদের আদর্শে ভর্তি করে নেয় কিছু বক্তৃতা আর কিছু রাইফেলের গুঁতোয়, মানে ওটাই যদি মেনস্ট্রিম-মতবাদ হয়ে পড়ে, তা হলে আজ থেকে তিরিশ বছর বাদে কি এই মাতৃঘাতী লোকটারই স্ট্যাচু নির্মিত হবে না? তাকে নিয়ে বীরগাথা সিলেবাসে ঢুকে যাবে না? তখন কি আমরা মনে করব না, এই পরিমাণ আত্মত্যাগ, মা’কে ভালবেসেও দাঁতে দাঁত চেপে তাঁরই কপালে বুলেট ভরে দেওয়া, এই লোকটির জীবন-অগ্নির দ্যোতক, এবং তার সংক্রমণ সমাজের পক্ষে মঙ্গলজনক, অর্থাৎ, এঁর মতো হ রে ভ্যাবলা, একেই বলে ডেডিকেশন!
আর পড়ুন
ইরাকে ১৪০০ বছরের প্রাচীন খ্রিস্টান মঠ গুঁড়িয়ে দিয়েছে আইএস