নীতি ঘোষণা করিতে কষ্ট নাই। নীতির প্রয়োগ কঠিন। উৎপাদন শিল্পের প্রতি ভারত কতটা অনুকূল, সে বিষয়ে নীতি আয়োগের একটি সমীক্ষা ফের সেই পরিচিত সত্যে দাগ বুলাইল। ভারতের প্রধান রাজ্যগুলিতে সংগঠিত ক্ষেত্রে তিন হাজারেরও অধিক ছোট-বড় উৎপাদন শিল্পের উপর সমীক্ষা বলিতেছে, অগ্রগতি সামান্য। এমনকী কেন্দ্রের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নীতি আদৌ কোনও পরিবর্তন আনিয়াছে কি না, তাহাতেও সংশয়ী শিল্প মহল। কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতির অবনতি হইয়াছে, এমনও বলিয়াছেন শিল্পকর্তারা। শিল্প প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হিসাবে কেন্দ্র এবং রাজ্য, উভয়ের নানা দফতর হইতে ছাড়পত্র প্রয়োজন। এগুলির প্রধান উদ্দেশ্য পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র এবং সামাজিক কল্যাণের সহিত শিল্পের সংঘাত যাহাতে না হয়, তাহা নিশ্চিত করা। সেখানেই লাল ফিতার ফাঁস আঁট হইয়া বসিতেছে। জমি পাইতে, নির্মাণের ছাড়পত্র জোগাড় করিতে একশো দিনেরও অধিক লাগিতেছে, বিদ্যুৎ সংযোগ পাইতে বাহান্ন দিন। ইহা জাতীয় গড়, বলা বাহুল্য অনেক রাজ্যে পরিস্থিতি আরও মন্দ। শিল্পের প্রতি সরকারের আর একটি দায়বদ্ধতা, শিল্প-সম্পর্কিত অভিযোগের দ্রুত আইনি মীমাংসার ব্যবস্থা। কিন্তু অধিকাংশ শিল্পকর্তার মত, সেই প্রক্রিয়ার উন্নতি হয় নাই। সমীক্ষাও বলিতেছে, কোনও অভিযোগের ফয়সালা হইতে গড়ে দুই বৎসর লাগিয়া যায়। আকর্ষণীয় পরিসংখ্যান নহে।
মোটের উপর শিল্প স্থাপন করিবার বা চালু রাখিবার সুবিধা বাড়িয়াছে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তরে এক-তৃতীয়াংশ শিল্পকর্তা সদর্থক জবাব দিয়াছেন, পাঁচজনে একজন নঞর্থক। এই চিত্র খুব আশাব্যঞ্জক নহে। ভারতকে শিল্প-অনুকূল করিয়া তুলিবার অঙ্গীকার করিয়াছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁহার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নীতির প্রতীক সিংহ, ভারতে যাহা গুজরাতের গির অরণ্যেই কেবল মিলিয়া থাকে। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে লগ্নি টানিতে এবং শিল্পে উন্নতি করিতে মোদী সফল, এমন একটা মত বহুল প্রচারিত। তাই দেশবাসীর তাঁহার উপর ভরসা করিবার কারণ ছিল যথেষ্ট। কিন্তু নীতি আয়োগের সমীক্ষা দেখাইল, সিংহের চাইতে শম্বুকই আজও উপযুক্ত প্রতীক। মাত্র কুড়ি শতাংশ শিল্পকর্তা ‘এক জানালা ব্যবস্থা’, অর্থাৎ একটিই কর্তৃপক্ষের কাছে সকল প্রকার ছাড়পত্র ও সুবিধা পাইবার ব্যবস্থার কথা জানেন। এই পরিস্থিতিতে বিদেশি সংস্থারা কেন লগ্নিতে আগ্রহ দেখাইবে?
বিশেষত বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক ‘শিল্প চালাইবার সুবিধা’ শীর্ষক রিপোর্টে যে ছবি প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা কেবল দিল্লি ও মুম্বইয়ের পরিসংখ্যানের উপর রচিত হওয়ায় কিছুটা উজ্জ্বল। নীতি আয়োগের সর্বভারতীয় চিত্রটি অনেক বেশি ম্লান। সমস্যা কোথায়, তাহারও ইঙ্গিত মিলিয়াছে। কেন্দ্র যতই উচ্চাশা লইয়া নীতি প্রণয়ন করুক না কেন, তাহার রূপায়ণ হইবে রাজ্যে। কেন্দ্র যতগুলি ছাড়পত্র দেয়, তাহার তিনগুণ দেয় রাজ্য। অতএব শিল্পের প্রশ্নে রাজ্যগুলির সহিত কেন্দ্রের শিল্প বিকাশ নিগমের যথেষ্ট সংযোগ ও সহযোগিতা না থাকিলে শিল্পের পরিকাঠামোর উন্নতি হইবে না। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতেও যে তাহার নিদর্শন মেলে নাই, ইহা শিল্পের জন্য শুভবার্তা নহে। আশার কথা এই যে, সমস্যার সমীক্ষা ও তাহার প্রকাশ অন্তত হইয়াছে। সমাধানও অজানা নহে। প্রয়োজন সৎ প্রচেষ্টার।