গাঁধীগিরির গোলাপে লজ্জা নেই, যাত্রাভঙ্গ চোখের জলে

শ্বাসনালীতে আটকে থাকা কোনও বস্তুকে বার করে দিলে এবং রোগীকে ঠিকঠাক শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়াতে পারলে পরবর্তী চিকিৎসা অনেক সহজ হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:০৯
Share:

বছরখানেক হয়ে গেল। দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল ‘মা’ ফ্লাইওভারে। এক অসাবধানী ক্যাব চালক ভোরে ডিভাইডারে গিয়ে ধাক্কা মারেন। গাড়িতে ছিল কৃষ্ণনগরের এক চিকিৎসকের মেধাবী সন্তান। মাথায় আঘাত পায় ছেলেটি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে মৃত্যু হয় তার। একটা সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়।
খবরগুলো পুরনো হয় না। গত ৮ ডিসেম্বর মিনাখাঁর মালঞ্চ সেতুতে দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় দুই যুবকের। প্রায় সব প্রথম শ্রেণির দৈনিকে খবরটা বেরিয়েছিল। হুগলির গুড়াপের কাছে পথ দুর্ঘটনায় মারা যান গায়ক তথা কালিকাপ্রসাদ। দোহার ব্যান্ডের প্রাণপুরুষ। রোজই কিছু খবর ভেসে ওঠে আর হাজার হাজার দুর্ঘটনার খবর অনেককে চোখের জলে ভাসিয়ে খবর না হয়ে তলিয়ে যায়।
পাঁচ থেকে উনত্রিশ বছরের বহু মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণ পথ দুর্ঘটনা। আর ভাবতে অবাক লাগে মোট পথ দুর্ঘটনার ৯৩ শতাংশই ঘটে উন্নয়নশীল দেশগুলোয়। যেখানে উন্নত দেশগুলোর থেকে প্রায় ষাট শতাংশ কম গাড়ি চলে। আরও অবাক করা হিসেব হল, অন্য সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলেও পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে পৃথিবীর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে রেখেছে আমাদের দেশ। এই বছরের ডিসেম্বরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘ হু’ প্রকাশ করেছে ‘গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি’। আর তাতেই উঠে এসেছে ভয়ঙ্কর সব তথ্য। প্রতি বছর মারা যাচ্ছে ১.৩৫ মিলিয়ন মানুষ। সব বয়সের মানুষের মৃত্যুর ক্ষেত্রে পথ দুর্ঘটনা অষ্টম প্রধান কারণ। আর উন্নত দেশগুলিতে গাড়ির সংখ্যা যতই বেশি হোক, উন্নতশীল বা গরিব দেশগুলোয় তিন গুণ বেশি মানুষ মারা যায় পথ দুর্ঘটনায়।
সাধারণত অন্য দেশে দুর্ঘটনার একটা নির্দিষ্ট ধরন আছে। চার চাকার গাড়ির চালক আর পথচারীদের মৃত্যুর সংখ্যা অনুপাতে বেশি। সেখানে ভারতে পথ দুর্ঘটনায় চল্লিশ শতাংশ মৃত্যুই হয় দু’চাকা বা তিন চাকার গাড়ির যাত্রীদের। চার চাকার ছোট গাড়ির চালকদের মৃত্যু যেখানে ছয় শতাংশ সেখানে এই সব গাড়ির যাত্রীর মৃত্যু ১২ শতাংশ। কয়েক দিন আগেও পেট্রল পাম্পে একটু কড়াকড়ি চলছিল, হেলমেট মাথায় না থাকলে তেল দেওয়া হচ্ছিল না। ট্রাফিক পুলিশেরাও নিয়ম মেনে না চলা মানুষদের হাতে গোলাপ ফুল ধরিয়ে দিয়ে লজ্জা দেওয়ার চেষ্টায় ছিল। ‘ডিমান্ড সাপ্লাই’-এর নিয়ম মেনে গোলাপের দামটাই শুধু বেড়ে গেল। গাঁধীগিরির কোনও দাম রইল না।
রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে মাত্র ৩০ শতাংশ মোটরসাইকেল চালক হেলমেট পরেন। আর পিছনে যাঁরা বসেন, তাঁদের মাথা ঢাকার হার ১০ শতাংশেরও কম। ২০১৭ সালে ভারতে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে চার লক্ষ ৬৯ হাজার ৯১০ জনের। এটা সরকারি হিসাব। তবুও যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করে গাড়ি চালানো হচ্ছে না। পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, শুধু ঠিকঠাক ভাবে হেলমেট পরলেই ৪২ শতাংশ আঘাতজনিত মৃত্যু হ্রাস পায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে ২০১১ সালের মে থেকে শুরু করে ২০২০ সাল পর্যস্ত সময়কে পথ সুরক্ষা দশক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১১০টি দেশ এতে যোগ দিয়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, ২০২০ সালের মধ্যে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার অর্ধেকে কমিয়ে আনা হবে। কিন্তু ২০১৮ সালের রিপোর্টে স্পষ্টই বুঝে নেওয়া গিয়েছে, সেটা আর সম্ভব নয়। ডক্টর টেড্রোস অ্যাধানম ঘেব্রেইয়োসাস, ‘হু’র ডিরেক্টর জেনারেল জানিয়েছেন যে ২০১৯ থেকে ২০২৩ এই পাঁচ বছরে কিছু লক্ষ্যমাত্রা রেখে সদস্য দেশগুলি এগোবে। তাতে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর হার কমতে পারে।
নদিয়া জেলা হাসপাতালের শল্য চিকিৎসক হিসেবে বোঝা যায়, পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর। সাধারণ অস্ত্রোপচারের রোগীর চেয়ে অনেক বেশি রোগী দুর্ঘটনাজনিত আঘাত নিয়ে ভর্তি হয়। এই ধরনের রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রয়োজন হয়। শুধু শল্য চিকিৎসক নয়, অস্থিরোগ বিশেষজ্ঞ, চক্ষু ও নাক- কান- গলার চিকিৎসক, নার্স ও প্রশিক্ষিত ‘ওটি বয়’ ছাড়াও বিশেষ ভাবে প্রয়োজন নিউরোসার্জন। সেই সঙ্গে মানুষকেও সচেতন হতে হবে। দুর্ঘটনাস্থলেও ফার্স্ট এড এবং প্রাথমিক কিছু চিকিৎসা করা উচিত। এগুলি সাধারণ মানুষও করতে পারে, চিকিৎসক হওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু প্রয়োজন মানবিক হওয়ার।
ডক্টর সফার ১৯৫০ সাল নাগাদ লক্ষ করেন, শ্বাসনালীতে আটকে থাকা কোনও বস্তুকে বার করে দিলে এবং রোগীকে ঠিকঠাক শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়াতে পারলে পরবর্তী চিকিৎসা অনেক সহজ হয়। তিনি এয়ারওয়ের ‘এ’ এবং ব্রিদিং-এর ‘বি’ নিয়ে ট্রমা ম্যানেজমেন্টের ‘এবি’ তৈরি করেন। পরে ডক্টর কাউয়েনহোভেন ‘সি’ অর্থাৎ সারকুলেশন বা রক্ত চলাচল যোগ করেন। ১৯৭৬ সালে স্টাইনার ডিসএবিলিটি ও এক্সপোজারের ‘ডি’ এবং ‘ই’ যোগ করেন। এতে কোনও রকম আঘাতজনিত অক্ষমতা তৈরি হয়েছে কি না দেখা হয় আর রোগীর দেহে আরও আঘাত আছে কি না, ভাল করে পরীক্ষা করে নেওয়া হয়। এই ‘এবিসিডিই’ যদি ঠিক ভাবে দেখা নেওয়া যায়, তা হলে অনেক প্রাণ বাঁচিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।
আর সাবধান হতে হবে নিজেকেও। সচেতন করতে হবে অন্য সবাইকে। বিশেষ করে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের। শুধু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্যপূরণই নয়, আমাদেরও ভাবতে হবে, আমরা এই দেশটাকে মৃত্যু উপত্যকা করে রাখব কি না।

Advertisement

শল্য চিকিৎসক, নদিয়া জেলা হাসপাতাল, কৃষ্ণনগর

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন