Festival

ভোটবাজারে পরিবেশে নম্বর কই

 এই পরিবেশ বিপর্যয়ের দায় কার? রাজ্যের মুখ্যসচিব জানিয়েছিলেন, অন্যান্য রাজ্যের মতো এ রাজ্যেও বর্ষবরণের উৎসবে বিধিনিষেধ নিষ্প্রয়োজন।

Advertisement

জয়ন্ত বসু

শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২১ ০০:৪০
Share:

বর্ষবরণের রাতে শহরে দেদার বোমার আওয়াজ বুঝিয়ে দিল কলকাতা আছে কলকাতাতেই। দীপাবলিতে শব্দবাজি কমতে অনেকে ভেবেছিলেন, কোভিড-আক্রান্ত শহর বুঝি অবশেষে সচেতন হল। তাঁরা বুঝলেন বিষয়টা এত সহজ নয়। বস্তুত কেন দীপাবলিতে বাজি কম আর নতুন বছরের উদ্‌যাপনে মাত্রাছাড়া, এই অঙ্কের সমাধানেই আছে শহর ও রাজ্যের পরিবেশরক্ষার চাবিকাঠি।

Advertisement

বর্ষবরণের রাতে পার্ক স্ট্রিট-সহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় কোভিড-নিয়মকে ছুড়ে ফেলে হাজারো মানুষের গা-ঘেঁষাঘেঁষি ভিড়, হোটেল-রেস্তরাঁয় মধ্যরাত্রি পেরিয়ে বছর আবাহনের আনন্দ উৎসব, নিয়ম ভেঙে ডিজে বাজিয়ে জলসা আর গগনভেদী শব্দবাজি ফাটানোটাই তো দস্তুর। কেন্দ্রীয় দূষণ পর্ষদের তথ্য বলছে কলকাতার ১০টি স্বয়ংক্রিয় শব্দ পরিমাপক যন্ত্রের ৮টিতেই নতুন বছর আসার এক ঘণ্টা পর পর্যন্ত শব্দের মাত্রা আগের ঘণ্টার তুলনায় বেশ বেড়েছিল, যেখানে উল্টোটাই হওয়ার কথা। রেহাই পায়নি হাসপাতাল অঞ্চলও। শহরের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে শব্দমাত্রা সর্বোচ্চ অনুমোদিত সীমার প্রায় ৪০ ডেসিবেল উপরে ছিল। যেখানে তিন ডেসিবেল বাড়া মানে শব্দের তীব্রতা দ্বিগুণ হওয়া। মাত্রা ছাড়ানো বায়ুদূষণ তো আছেই।

এই পরিবেশ বিপর্যয়ের দায় কার? রাজ্যের মুখ্যসচিব জানিয়েছিলেন, অন্যান্য রাজ্যের মতো এ রাজ্যেও বর্ষবরণের উৎসবে বিধিনিষেধ নিষ্প্রয়োজন। যে রাজ্যে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৯,৮৫০ জন কোভিডে মৃত, এখনও প্রতি দিন কমবেশি ২৫ জন মারা যাচ্ছেন, যে রাজ্য কোভিড মৃত্যুর হারে দেশে প্রথম সারিতে; সেখানে রাজ্য প্রশাসনের এমন শংসাপত্র মানুষের মধ্যে ভুল সুরক্ষার ধারণা চারিয়ে দেয়। নিয়মভঙ্গকারীদের উৎসাহ দেয়। রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক অধিকর্তার সঙ্কেত বুঝে বর্ষবরণের রাতে আইনি ক্ষমতা থাকলেও পুলিশ যে মাঠে নামবে না বা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ চিঠি পাঠিয়েই কর্তব্য সারবে, তাতে আশ্চর্য নেই। নিট ফল বর্ষবরণের মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করল আইনভঙ্গকারীরা, প্রশাসন স্রেফ অনুপস্থিত। অথচ দেওয়ালির রাতে কিন্তু আদালতের নির্দেশ আর সচেতন সমাজের যৌথ চাপে প্রশাসন মাঠে নেমেছিল আর আইনভঙ্গকারীদের দেখা যায়নি।

Advertisement

নব্বইয়ের দশক থেকেই দেখা গিয়েছে, সক্রিয় আদালত আর সচেতন সমাজ এক হলে তবেই পরিবেশ সমস্যার কিছু সুরাহা সম্ভব। দিল্লির বায়ুদূষণ, পূর্ব কলকাতার জলাভূমি রক্ষা, এমনকি কলকাতার শব্দদূষণ সামলাতে এই পথই নিতে হয়েছে। তবে িকনা, এটা খানিকটা স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসার মতো— স্থায়ী সমাধান হয় না।

আগামী বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলি নানা ফর্মুলা নিচ্ছে। দল ভাঙানো, পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির সঙ্গেই জনগণেশের সেই অংশকে সঙ্গে রাখা হচ্ছে, যারা ভোট-বৈতরণি পেরোতে সহায় হবে। যারা দিনরাত মাইক, ডিজের তাণ্ডব করে বা বোম ফাটিয়ে উৎসব করে; তাদের বড় অংশই রাজনৈতিক দলগুলির কাছে জরুরি। ফলে শব্দ আইন ভাঙার প্রতিবাদে কোনও দলই এগিয়ে আসে না। প্রয়াত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ “কেউ কাউকে জোর করে শব্দ শোনাতে পারে না”-কে ছুড়ে ফেলে যেন শব্দযন্ত্রণা পাওয়াটাই আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্বে পর্যবসিত হয়েছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহু মানুষ শহিদ হয়েছেন, অত্যাচারিত হয়েছেন। রাজ্যের প্রথম শব্দশহিদ দীপক দাসের বাড়ি গিয়ে দেখেছিলাম, বাড়ির মানুষেরা ভয়ে গুটিয়ে রয়েছেন, বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে দীপকবাবুর খুনিরা। সরকার পাল্টালেও ছবিটা পাল্টায়নি, অন্য দল এলেও পাল্টাবে না।

রাজনৈতিক দলগুলি মনে করে ভোটের অঙ্কে পরিবেশের তেমন নম্বর নেই। কারণ গড়পড়তা মানুষের কাছে রোটি, কপড়া ও মকানের গুরুত্বই বেশি। যাঁর রোজগার নেই, বাড়ির সামনের পাহাড়প্রমাণ জঞ্জাল নিয়ে তিনি কেন মাথা ঘামাবেন! এই ভাবনা আজকের নিরিখে বেশ খানিকটা ঠিক হলেও চিরকাল একই রকম থাকবে না। যদি থাকত তবে পরিবেশ নিয়ে শোরগোলের অনেক আগে ষাটের দশকে রেচেল কার্সনের ধাক্কায় আমেরিকাকে কীটনাশক নীতি আমূল পরিবর্তন করতে হত না, বা সত্তরের চিপকো আন্দোলন মসনদকে নাড়িয়ে দিতে পারত না। ইদানীং দূষণ নিয়ে দিল্লির রাজনীতিও তপ্ত হত না। আজ ইন্টারনেট বা মোবাইলে পৃথিবীর দূরতম বিন্দুও আঙুলের ডগায়, প্রতি মুহূর্তে মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাড়ছে; সেখানে উন্নত পরিবেশের চাহিদাও ক্রমে বাড়বে। রাজনৈতিক দলগুলিকে মনে রাখতে হবে, শহরে ও গ্রামে পরিবেশ নিয়ে অসংখ্য তিতিবিরক্ত মানুষ রয়েছেন, যাঁরা হয়তো ভোটের বাক্সেই সুদেআসলে পুষিয়ে নেবেন।

তাই, নীরব না থেকে, দুয়ারে রাজনীতিকরা এলে পরিবেশকর্মী থেকে সাধারণ মানুষ যদি জল, জঙ্গল, বাতাসের নিরাপত্তার আর শব্দদানবকে বোতলবন্দি করার দাবি তোলেন, ভাল হয়। ভোট-রাজনীতির মঞ্চেই হয়ে যাক পরিবেশের এসপার-ওসপার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন