পর্বান্তর: অটলবিহারী বাজপেয়ী ও নরেন্দ্র মোদী। দুই যুগ, দুই নায়ক, দুই মানসিকতা
সেটা ১৯৯৮ সালের লোকসভা নির্বাচনের বেশ কিছু দিন আগের কথা। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে এক বার চেন্নাই গিয়েছিলাম। তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী নন। সমুদ্রসৈকতেই জনসভা। সন্ধ্যায় হুহু করে সমুদ্রের হাওয়া এসে খালি লাল প্লাস্টিকের চেয়ারগুলো উড়িয়ে দিচ্ছিল। বাজপেয়ী বোঝাচ্ছেন কেন এই ভারত নামক দেশটিতে পদ্মফুল ফোটানো প্রয়োজন। হিন্দিতে বলছেন, আর এক রাজ্য নেতা তা তামিল ভাষায় অনুবাদ করছেন। বালির ওপর ডাবওয়ালা, মাছওয়ালার স্টল ঘিরে কত মানুষ। কেটলি নিয়ে ফিলটার কফি আসছে যাচ্ছে। কিন্তু বাজপেয়ীর মতো বাগ্মী নেতার বক্তৃতা শুনতে তামিল জনতা কোথায়? বেণিতে বেল ফুলের মালা, এক কৃষ্ণবর্ণাকে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, যিনি বক্তৃতা দিচ্ছেন তাঁকে চেনেন? মহিলা জানিয়েছিলেন, তিনি আম্মাকে চেনেন। অটলবিহারী বাজপেয়ী কে, জানেন না।
আজ এত বছর পরে এম কে করুণানিধির পুত্র স্ট্যালিনের কণ্ঠে ‘দ্রাবিড়নাড়ু’র কথা শুনে সে-দিনের কথা মনে পড়ে গেল। সমুদ্রের কাছেই ‘প্রেসিডেন্ট হোটেল’ বলে তখন একটা হোটেল ছিল। আমরা সেখানেই উঠেছিলাম। বাজপেয়ীজি খুব প্র্যাকটিক্যাল মানুষ ছিলেন। ভাবের ঘরে চুরি করেননি। জনসভা থেকে হোটেলে ফিরে সে-দিন সন্ধ্যায় আমাকে বলেছিলেন, ভারত বড় দেশ। এই রাজ্যের তামিলরাই সবচেয়ে বেশি হিন্দি-বিরোধী রাজনীতি করেছিল। তোমাদের বাঙালিদের চেয়েও বেশি। লোকে আমাদের হিন্দি পার্টি বলে। তাই এখানে জোট শরিক চাই। বিজেপি চাইলেও এখানে দাঁত ফোটাতে পারবে না। চেন্নাইতে আজও স্থানীয় বাসিন্দারা হিন্দি জানলেও বলতে চান না। হিন্দিতে প্রশ্ন করলে গাড়ির চালক ইংরেজিতে জবাব দেবেন, তবু হিন্দি বলবেন না। প্যারিসে গিয়ে ইংরেজি বললে ফরাসি দোকানদাররা যেমনটা করে আর কী।
জোট রাজনীতির সঙ্গে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় বিভিন্নতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ১৯৯৬ সালে বাজপেয়ী তেরো দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েও বিদায়
নিতে বাধ্য হন সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায়। ১৯৯৮ সালে জয়ললিতা প্রথম এনডিএ-তে শরিক হলেন এবং অটলবিহারী বাজপেয়ী আবার প্রধানমন্ত্রী হলেন। জয়ললিতার সঙ্গে এল আরও ছোট-ছোট দ্রাবিড় দল।
কংগ্রেসের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার এ-দেশে ছিল ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত। ভুললে চলবে না, এর পর সাতটি নির্বাচনে ফলাফল ত্রিশঙ্কু হয়। (১৯৮৯, ১৯৯১, ১৯৯৬, ১৯৯৮, ১৯৯৯, ২০০৪ এবং ২০০৯)। নরেন্দ্র মোদীই প্রথম বিজেপিকে একক ভাবে ক্ষমতায় পৌঁছে দিলেন। ২০১৪ সালের ভোটের সময় আমরা আলোচনা শুরু করে দিয়েছিলাম, আসবে এক নয়া হিন্দুত্ব, যাকে আমরা সাংবাদিকরাই নাম দিয়েছিলাম, ‘মোদীত্ব’। হিন্দু এবং হিন্দি জাতীয়তাবাদের এক সমগ্র ভারতীয় সত্তা + অখণ্ড শক্তিশালী রাষ্ট্র।
চার বছর পর? তামিলনাড়ুর শাসক বিরোধী, দু’পক্ষই রাজ্যের প্রতি বঞ্চনার অভিযোগে আন্দোলনের প্রতিযোগিতা শুরু করেছেন। অন্ধ্রপ্রদেশে শুধু চন্দ্রবাবু তো নয়, জগন্মোহন রেড্ডিও রাজ্যের জন্য বিশেষ আর্থিক প্রস্তাবগুচ্ছের দাবিতে সরব। অন্ধ্রপ্রদেশকে দেখে তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রীও উত্তপ্ত। তিনিও অভিযোগ করছেন, তেলঙ্গানা নিয়ে কেন্দ্র প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে না। কাবেরীর জল নিয়েও গোলমাল। কন্নড় খণ্ডজাতীয়তার পারদ ঊর্ধ্বমুখী। মোদী সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলেন, কিন্তু বিজেপি প্যানইন্ডিয়ান পার্টি হতে পারছে কই?
এ-দেশের বহুত্ববাদের বৈচিত্রকে একটা অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কার্পেটের নীচে লুকিয়ে রাখা যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নয়, সেটা বিজেপির শীর্ষ নেতারা এখনও বুঝতে পারছেন কি? গোটা দেশের উপর অধিকার অর্জনের বাসনা রাজনেতার হতেই পারে, সে তো সেই কোন মুঘল আমলে সম্রাট আওরঙ্গজেবও দিল্লিতে বসে দাক্ষিণাত্য বিজয় করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ বলা হয় তাঁর দাক্ষিণাত্য নীতি। বরং বিভিন্নতার জোটের সঙ্গে আপসই গণতন্ত্র। কিরেণ রিজিজু গোমাংস ভক্ষণ করেন। আর দিল্লির তখ্তে বসে গোহত্যা বন্ধের প্রচার হয়। হিন্দুত্বের নামে নিরামিষ খাদ্যাভ্যাসকে সুকৌশলে সরকারি স্তরেও আবশ্যিক করার চেষ্টা। ফলে আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে বই কমছে না। ইটালি, জার্মানি থেকে সোভিয়েট ইউনিয়ন— ইতিহাসের নানা সময়ে এক-জাতির ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা বুমেরাং হয়েছে। টুকরো-টুকরো হয়ে গিয়েছে সে-সব দেশ। আর এ-দেশেও রাষ্ট্রটাকে স্টিমরোলার চালিয়ে একমাত্রিক বানানোর ছেলেমানুষি চেষ্টার ফলও তো আমরা আজ চোখের সামনে দেখছি।
বিশ্বায়ন এক দিকে যেমন নানা পরিচয়ের একটা অভিন্ন মঞ্চে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়, আবার ভিন্ন ভিন্ন সত্তার স্বকীয়তা বাড়িয়েও দেয়। তাই বার্গার যেমন গ্রামেও ঢুকেছে, তেমন নিরামিষ পনির-বার্গার জনপ্রিয় হচ্ছে গ্রামে। জাতীয় দল কংগ্রেস দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে বিবিধ আঞ্চলিক প্রত্যাশায় ব্যর্থ হলে, নতুন-নতুন আঞ্চলিক দলের জন্ম হয়। তাদের পৃথক ভোটব্যাঙ্ক তৈরি হয়। কংগ্রেসের অবক্ষয়ের সুযোগ নিয়ে বিজেপিও জোট রাজনীতি শুরু করে। নানা আঞ্চলিক দলকে সঙ্গে নিয়ে এক নয়া কেন্দ্র-রাজ্য ভারসাম্যের রাজনীতি তৈরি হয়। একক ক্ষমতার গত চার বছরে এই কেন্দ্র-রাজ্য ভারসাম্য আবার বিঘ্নিত।
কেন্দ্র-রাজ্য ভারসাম্য, জোট রাজনীতি ও আঞ্চলিক দলগুলির কণ্ঠস্বরের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। বাজপেয়ীর এনডিএ ছিল জোট সরকার। বিজেপির একক গরিষ্ঠতা না থাকায় আঞ্চলিক দলগুলিকে মর্যাদা দিতে হয়েছিল। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আমাকে বলেছিলেন, বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হলেও আমার সরকার রাজ্যগুলিতে প্রতিটি প্রত্যন্ত গ্রামেও বিকাশ পৌঁছে দেবে। তাতে আঞ্চলিকতারও অবসান হবে। বলেছিলেন, শুধু হৃৎপিণ্ডে রক্ত জমলে তো মানুষের মৃত্যু হবে। গোটা শরীরে রক্ত সংবহন প্রয়োজন। লিখেছিলাম সে কথা।
চার বছর পর বুঝছি, বিকাশের স্লোগান যতটা স্লোগান হিসাবে জনপ্রিয় হয়েছে, বাস্তবের জমিতে তা দেখা যায়নি। কোথায় চাকরি? কোথায় উন্নয়ন? উল্টে রাজ্যে-রাজ্যে দলিত, কাশ্মীরি জেহাদি, কৃষক, ছাত্র, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, আদিবাসীদের বিদ্রোহ। আঞ্চলিকতার এই বিচ্ছিন্নতা ধামাচাপা দিতে এল সঙ্ঘপরিবারের সর্বরোগহরা বটিকা। মেরুকরণের রাজনীতি। তুমি তামিল, কিন্তু তার আগে তুমি হিন্দু। তুমি বাঙালি, তবে আগে তুমি হিন্দু। ইসলাম ধর্ম হতে পারে তোমার, কিন্তু তুমি ভারতীয়, অতএব তুমি হিন্দু জাতিরই অংশ। এ-ভাবে সব ধর্ম, সব জাতি, সব অঞ্চলের একাত্মীকরণ করতে গিয়ে তার কী পরিণতি হতে পারে, তা-ও তো টের পাচ্ছি। একাত্মীকরণ? শিবসেনা, তেলুগু দেশমের মতো শরিক দলগুলিও সরে দাঁড়াচ্ছে।
এখন মনে হয়, একদলীয় একনায়কতন্ত্রের চেয়ে জোট সরকারের বাধ্যবাধকতা বোধহয় এই বিশাল ভারতের গণতন্ত্রের পক্ষে শ্রেয়। একদলীয় শাসকের এহেন আধিপত্য ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় বিভিন্নতাকেই যদি বিপন্ন করে তবে সে কিসের অচ্ছে দিন? বসন্তের কোকিল কেশে-কেশে রক্ত তুলবে, সে কিসের বসন্ত?