প্রথমে ছিল ইরান। গত মাসে নয়াদিল্লি আসিয়া ইরানের বিদেশমন্ত্রী জাভাদ জ়ারিফ সহর্ষে ঘোষণা করিয়াছিলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান হইতে পণ্য আমদানি বন্ধ করে নাই ভারত। এক ধাপ আগাইয়া ইরানকে ‘ভারতীয় অর্থনীতির কিয়দংশ’ বলিয়াও বর্ণনা করেন মন্ত্রী। সেই যাত্রায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকড়ীর সহিত ইরানের চাবাহার বন্দর লইয়াও বৈঠক হয়। স্মরণে রাখা আবশ্যক, ভারত-ইরান-আফগানিস্তানের মিলিত উদ্যোগে নির্মিত চাবাহারের ক্ষেত্রে একগুচ্ছ শর্ত চাপাইয়া শেষাবধি ভারতকে নিষেধাজ্ঞার বাহিরে রাখিয়াছিল আমেরিকা। এবং নিস্তার পাইবার পথটি মিলিয়াছিল ভারতের কূটনৈতিক অতি-সক্রিয়তায়। ভারত সকলকে বুঝাইতে পারিয়াছিল, চাবাহার বন্দর কৌশলগত ভাবে গুরুত্ববাহী, কারণ এই পথেই তাহাদের পক্ষে পাকিস্তানকে এড়াইয়া আফগানিস্তানে প্রবেশ করা সম্ভব। প্রশ্নটিকে আঞ্চলিক করিয়া তুলিবার ফলে আমেরিকাকে চাবাহারের গুরুত্ব বুঝাইতে আসরে নামিয়াছিল আফগানিস্তান। ইহাতে ভারতের বিচক্ষণতাই প্রকাশ পাইয়াছিল। যে হেতু ইরানের ন্যায় ভারতেরও চাবাহার বন্দরটির প্রয়োজন, অতএব আমেরিকার পুত্তলিবৎ আচরণ করে নাই দিল্লি।
অতঃপর ভেনেজ়ুয়েলা। নিষেধাজ্ঞা সমরূপ হইলেও, বিশ্বের বৃহত্তম তৈলভাণ্ডার দেশে ভারতকে কোনও ছাড় দেয় নাই আমেরিকা। ভেনেজ়ুয়েলার অর্থনীতি তৈল-রাজস্বের উপর নির্ভরশীল, এবং মার্কিন ক্রয় বন্ধ হইবার পরে ভারতের অভিমুখেই তাকাইয়া কারাকাস, ভারতই তাহাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা। সম্প্রতি ভারতে আসিয়া ভেনেজ়ুয়েলার তৈলমন্ত্রী জানাইয়াছেন, ভারতে তৈল বিক্রয়ের পরিমাণ বাড়াইতে ইচ্ছুক তাঁহার দেশ। স্পষ্টতই, অর্থনীতি কেন, রাজনীতির প্রশ্নেও আমেরিকার ভেনেজ়ুয়েলা-নীতি গ্রহণ করে নাই ভারত। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র জানাইয়াছেন, ভারত ও ভেনেজ়ুয়েলার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, এবং সেই দেশের মানুষ হিংসা নহে, রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হইবে। অর্থাৎ, আমেরিকার বিপরীতে হাঁটিয়া সমাজতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ন্যায্যতা দান করিতেও রাজি ভারত।
বস্তুত, চারি দিক হইতে মাদুরোকে ঘিরিয়া ফেলিতে দ্রোণাচার্যের ন্যায় ব্যূহ রচনা করিতে ইচ্ছুক আমেরিকা। ভেনেজ়ুয়েলার বিরোধী নেতা হুয়ান গুয়াইদো যখন নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করিয়াছিলেন, তখন অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তাঁহাকে সমর্থন এবং স্বীকৃতি দান করিয়াছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। তবে বিচক্ষণ রাজনীতিকেরা নিশ্চিত অবগত, বিরোধী নেতাকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করিয়া দিবার পদক্ষেপে চমক থাকিলেও কার্যকারিতা সামান্য। বাস্তবোচিত পন্থায় চলিলে প্রতিরক্ষা কিংবা অর্থনীতি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে হয়। অতএব তৈল। আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার হুঁশিয়ারি— কেহ যেন ভেনেজ়ুয়েলা হইতে তৈল ক্রয় না করেন। তাঁহার ঘোষণা, তৈল ক্রয়ের অর্থ হইবে মাদুরোর ‘তস্করবৃত্তি’তে ইন্ধন দান, আমেরিকাও ‘তাহা স্মরণে রাখিবে’। এতদ্সত্ত্বেও, মাদুরোর পার্শ্বে নির্মিত চক্রব্যূহে অবশিষ্ট কৌরবদের ন্যায় নিষ্প্রশ্ন সৈনিক হইতেছে না ভারত। পাকিস্তানের মতো জরুরি বিষয়ে আমেরিকা ভারতের পাশে না থাকিলে ভারতই বা কেন সব বিষয়ে আমেরিকার পাশে দাঁড়াইবে!