প্রতীকী চিত্র।
অপ্রিয় বিষয়ের দিকে না তাকালেই বিষয়টি অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে, এমন ধারণা ভুল। ঝড় উঠতে দেখে উটপাখি বালিতে মুখ গুঁজে থাকতেই পারে। কিন্তু তাতে ঝড় বন্ধ হয়ে যায় না। ক্ষয়ক্ষতিও এড়ানো যায় না। ডেঙ্গি এ রাজ্যে তেমন হচ্ছে না, ডেঙ্গি হতেই পারে না কলকাতায় বা আশপাশে— এমন এক ধারণা প্রায় জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে যেন। এই অপচেষ্টা কিন্তু সঙ্কট বাড়াচ্ছে বই কমাচ্ছে না।
অনেকগুলো মৃত্যুই তো খবরে চলে এল। শহরের নানা প্রান্ত থেকে মৃত্যুর খবর আসছে, বিভিন্ন বয়সের রোগীর মৃত্যুর খবর আসছে। কিন্তু সরকার এখনও রোগের দাপটের কথা অস্বীকার করতে চায়। এই সব মৃত্যু ডেঙ্গিতে, নাকি ডেঙ্গির কোনও অচেনা রূপের কারণে, নাকি সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা কোনও জ্বরের কারণে, সরকার এখন সেই নিয়ে নিগূঢ় তাত্ত্বিক তর্কে মেতে উঠতে চায়। তর্কে মেতে ওঠার সময় কিন্তু এটা নয়। পরিস্থিতি যে মোটেই নিয়ন্ত্রণে নেই, কয়েক মাস ধরে যে রোগ ছড়াচ্ছে এবং ছড়িয়েই চলেছে, রোগের প্রকোপ রোখাটাই যে এখন সবচেয়ে জরুরি— প্রশাসনে সেই উপলব্ধিটা সর্বাগ্রে দরকার, রোগের প্রকোপ এবং সংক্রমণ ঠেকাতে অত্যন্ত দ্রুত পদক্ষেপ করা দরকার। তার বদলে বিপর্যয় লুকিয়ে রাখার চেষ্টা যত্রতত্র, হুঁশিয়ারি চিকিৎসকদের প্রতি, শাসানি রোগ নির্ণয়কেন্দ্রগুলিকে।
সঙ্কট ঠিক কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে? সঙ্কট তথা প্রশাসনের কোপে পড়ার ভয় এত দূর পৌঁছেছে যে, অনেক চিকিৎসক আজকাল ডেঙ্গির উপসর্গ দেখলে চিকিৎসা করতে দ্বিধা বোধ করছেন। কোথাও আবার রোগ নির্ণয় কেন্দ্র রক্ত পরীক্ষা করতেই চাইছে না। কোথাও পরীক্ষায় ডেঙ্গি ধরা পড়লেও খাতায়-কলমে তা লেখা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে চিকিৎসা বিলম্বিত হচ্ছে বা বিপথগামী হচ্ছে। মৃত্যুর তালিকাও প্রলম্বিত হচ্ছে। মৃত্যুর পরেও অনেক হাসপাতাল বা চিকিৎসক লিখতে চাইছেন না, কোন রোগে মৃত্যু হল রোগীর।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গি ধরার যন্ত্র নেই পুর-ল্যাবে
এখনও কি টনক নড়বে না প্রশাসনের? রোগের প্রকোপ রোখার বদলে পরিভাষা নিয়ে গবেষণাতেই যেন বেশি উৎসাহ প্রশাসনিক কর্তাদের। যে রোগে মৃত্যু হচ্ছে, সেই রোগের নাম কী? জীবাণুটাকে ডেঙ্গির জীবাণু নামে ডাকা উচিত, নাকি অন্য কোনও নামে? প্রশাসন সে তর্কেই ব্যস্ত থাকতে চায়। এই ধরনের চর্চার সময় কিন্তু এটা নয়। এক দিকে যখন রোগের আতঙ্ক, তখন প্রশাসনের তরফ থেকে আর এক রকম আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাও একেবারেই কাম্য নয়। ডেঙ্গি হয়েছে, রিপোর্টে বা প্রেশক্রিপশনে বা ডেথ সার্টিফিকেটে এ কথা লিখলে প্রশাসনিক রোষানলে পড়তে হবে— এই আতঙ্কটা আরও মারাত্মক হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি এতে অধিকতর জটিল হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সহানুভূতি চাই, পাশে দাঁড়ানোর বার্তা চাই, চোখরাঙানি চাই না। প্রশাসন অন্ধ হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তাতে প্রলয় বন্ধ থাকবে না।