শিরোধার্য

রাজায় রাজায় যুদ্ধে প্রাণ যায় কচুরিপানার। সুদীর্ঘ কাল ধরিয়া বিপ্রতীপ মতাদর্শের সরকারের হাতে তুরস্কের নারীদেরও প্রাণ ওষ্ঠাগত বলিলে ভুল হইবে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share:

ছবি রয়টার্স।

একটি বস্ত্রখণ্ড যে কী প্রকট রূপে রাজনৈতিক হইয়া উঠিতে পারে, তুরস্কের নারীরা তাহা চোখের সামনে দেখিতেছেন। নারীর হিজাব বা মস্তকাবরণীর ব্যবহার বহু দেশের মুসলমান দস্তুর। কিন্তু সাধারণ অর্থে যাহা বেশভূষার বিশিষ্টতা, ধর্মীয় আদেশ বা রাজনৈতিক নির্দেশে তুরস্কে তাহাই পরিণত হইয়াছে বাধ্যবাধকতায়। জমানা আসিয়াছে, চলিয়াও গিয়াছে, তুরস্কের নারীরা কখনও বাধ্য হইয়াছেন হিজাব পরিতে, কখনও বা খুলিয়া তুলিয়া রাখিতে। আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্ক দেশ গড়িয়াছিলেন সর্বতো ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ ও মূল্যবোধের ভিত্তির উপরে। নারীর হিজাব পরা বারণ, তাহা না বলিলেও প্রকাশ্য স্থানে তাহার পরিধানের সক্রিয় বিরোধিতা করিতেন তিনি। ‘জন-পোশাক নির্দেশিকা’ চালু করিয়া তুরস্কের সরকারি প্রতিষ্ঠানে মহিলাদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ হইয়াছিল আশির দশকেই। ১৯৯৭-এ দেশের ইসলামপন্থী প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া তুরস্কের সেনা-কর্তৃপক্ষ তাহাই কঠোর হস্তে বাস্তবায়িত করে। কালক্রমে আসিয়াছে নতুন শাসক, বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এর্দোয়ানের জমানা কেবলমাত্র হিজাবের বাড়বাড়ন্তের সাক্ষীই নহে, সক্রিয় সমর্থকও।

Advertisement

রাজায় রাজায় যুদ্ধে প্রাণ যায় কচুরিপানার। সুদীর্ঘ কাল ধরিয়া বিপ্রতীপ মতাদর্শের সরকারের হাতে তুরস্কের নারীদেরও প্রাণ ওষ্ঠাগত বলিলে ভুল হইবে না। কয়েকটি প্রজন্মের নারীরা হইয়া দাঁড়াইয়াছেন এই রাজনৈতিক জগঝম্পের শিকার। গত শতকের আশি ও নব্বই দশক দেখিয়াছে, সরকারি কার্যালয়, সংসদ, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আদালতে কর্মরতা নারীর মাথায় হিজাব নাই। থাকিলে বরং শাস্তি হইত। চাকুরি মিলিত না, পারিবারিক ধর্মীয় অভ্যস্ততায় কেহ হিজাব পরিয়া বাহির হইলে ধর্মনিরপেক্ষতার রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ অবমানিত করিবার অপরাধে ভর্ৎসনা জুটিত বিস্তর। স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী মেয়েদের ক্ষেত্রেও একই কথা। যে গৃহবধূ নিজ সন্তানকে স্কুল হইতে লইয়া যাইতে আসিয়াছেন, তাঁহার হিজাব পরায় বাধা নাই, কিন্তু তিনিই ওই স্কুলে শিক্ষিকা হইয়া যোগদান করিলে হিজাব নিষিদ্ধ। স্বেচ্ছায় হিজাব পরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করিতে আসা নারী শিক্ষার্থীকে বাড়ি ফিরিয়া যাইতে হইয়াছে। অসংখ্য নারী বর্তমানে যাপন করিতেছেন দ্বিখণ্ডিত জীবন— শহরের যে অংশের আবহাওয়া ধর্মনিরপেক্ষ, সেইখান দিয়া যাইবার সময় তাঁহারা হিজাব খুলিয়া রাখেন, জায়গা ও সময় বুঝিয়া আবার মাথায় চাপাইয়া লন।

পরিস্থিতি বদলাইতেছে। তুরস্কের নারীরা সমাজমাধ্যমে ও প্রকাশ্যে সরব হইয়াছেন, অধিকার রক্ষায় সংস্থা ও আন্দোলন গড়িয়াছেন। এই অধিকার কেবল নারী হিসাবে অধিকার নহে, মানুষের অধিকার। ধর্ম, সমাজ বা রাজনীতি, সকল কিছুই হাতিয়ার হইয়াছে নারীর বিরুদ্ধে। মানুষের এই প্রতিষ্ঠানগুলি দেশে দেশে প্রধানত পুরুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলিয়াই নারীর দুর্দশার অন্ত নাই। তাহাকে কেহ মানুষ বলিয়া ভাবে না, শুধু নারী হিসাবে দেখে। রাজা আসেন রাজা যান; রাজনীতিপট উদারপন্থী থেকে পশ্চাদমুখী, প্রগতিশীল থেকে দক্ষিণমার্গী সকল প্রকার পরিবর্তনেরই প্রত্যক্ষ সাক্ষী হইয়া থাকে। পরিস্থিতি-নির্বিশেষে ধ্রুব ক্রীড়নক হন নারীরা। কর্তা— তিনি গৃহেরই হউন বা সরকারের— যাহা বলিবেন তাহাই শিরোধার্য। হিজাব তো বস্ত্রখণ্ড মাত্র।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন