আজকাল ভারতবর্ষের গ্রাম ও আধাশহর অঞ্চলে স্কুল আগের চেয়ে সহজলভ্য হয়েছে, কিন্তু শিক্ষার মানের তেমন উন্নতি ঘটেনি। এর ফলে গ্রামে তো বটেই, শহরাঞ্চলেও ‘টিউশন’ এখন ছাত্রছাত্রীদের কাছে আবশ্যিক হয়ে উঠেছে, তা সে যত ব্যয়সাপেক্ষই হোক না কেন।
এই টিউটোরিয়াল হোম-নির্ভর শিক্ষণপদ্ধতির বিন্যাস ও প্রকৃতি আমূল পাল্টে দেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে ইন্টারনেট প্রযুক্তি-নির্ভর একটি ধারণা, যাকে এক কথায় বলতে পারি অনলাইন টিউটরিং। ইন্টারনেট-নির্ভর তথ্যপ্রযুক্তি মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের এক সার্বিক ও বিশ্বজনীন সংযুক্তি ঘটিয়েছে। গড়ে উঠেছে ‘ভার্চুয়াল’ ক্লাসরুম-এর ধারণা। এমন অনেক সফটওয়্যার আছে, যা ব্যবহার করে কম্পিউটারের পর্দায় বক্তা ও শ্রোতা উভয় উভয়কে একসঙ্গে দেখতে পারে এবং শ্রোতাও বক্তা হয়ে কথোপকথনে অংশ নিতে পারে। এই প্রযুক্তিগত ধারণার নাম ওয়েব কনফারেন্সিং, আর এরই সফল প্রয়োগ অনলাইন টিউটরিং। দুনিয়া জুড়ে বহু ইন্টারনেট-নির্ভর প্রতিষ্ঠান জন্ম নিয়েছে, যাদের বলা যায় ‘ভার্চুয়াল টিউটোরিয়াল হোম’, যারা ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে ‘অনলাইন’ সংযোগ ঘটিয়ে শিক্ষাপদ্ধতিতে একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
এই অনলাইন টিউটরিং-এর মূল কথা হল ইন্টারনেটের সাহায্যে শিক্ষকের কম্পিউটারের সঙ্গে ছাত্রের কম্পিউটারের সংযোগ স্থাপন। দু’পক্ষের কম্পিউটারেই ক্যামেরা, স্পিকার এবং মাইক্রোফোন আছে, যাতে দু’জনেই দু’জনকে দেখতে ও শুনতে পায়। দু’জন না হয়ে অনেক জনও হতে পারে, কিন্তু সেই জটিলতায় এখন যাচ্ছি না। এই ভাবে ছাত্র-শিক্ষকের অনলাইন সংযোগ স্থাপিত হলে শিক্ষক-ছাত্র কম্পিউটারের মাধ্যমে ‘মুখোমুখি’ হতে পারেন।
এখন শিক্ষক পৃথিবীর এক প্রান্তে ও ছাত্র পৃথিবীর অন্য প্রান্তে থাকলেও যোগাযোগে কোনও বাধা নেই। যদি হাই-স্পিড ইন্টারনেট সংযোগ থাকে, তা হলেই তৈরি হতে পারে একটা ‘ভার্চুয়াল’ গৃহশিক্ষকতার পরিকাঠামো যেখানে শিক্ষক তাঁর নিজের ‘গৃহে’, ছাত্রও তার নিজের ‘গৃহে’, কিন্তু যে গৃহে তাদের দেখা হচ্ছে বা পঠনপাঠন হচ্ছে, সেটা কোনও ইট-কাঠ-পাথরের গৃহ নয়, সে গৃহ আছে ইন্টারনেট মেঘের (ক্লাউড) মধ্যে।
আর, এর সম্ভাবনা সুদূরপ্রসারী। বিশেষ করে, এখন হাই-স্পিড-ইন্টারনেট অনেক সহজলভ্য, দ্রুত সেই সুবিধা বেড়ে চলেছে। তার ফলে, অনলাইন সংযোগ-স্থাপন এখন প্রযুক্তিগত ভাবে অনেক সহজ ও স্বাভাবিক। নিজের ঘরে ছাত্রছাত্রীকে না এনেও শিক্ষক এখন তাঁর ঘরে বসেই পড়াতে পারবেন। আবার অন্য দিকে, ছাত্রছাত্রীও নিজের ঘরে বসেই পড়তে পারবে। শুধু তাদের দেখা হবে কম্পিটারের মধ্যে দিয়ে।
এই প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যপদ্ধতি মোটামুটি একই। এখানে আগ্রহী শিক্ষক নিজেদের পরিচয় নথিভুক্ত করেন। সেই শিক্ষকমণ্ডলীর মধ্যে থেকে আগ্রহী ছাত্র বা ছাত্রী তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষক নির্বাচন করে। তার পর তাদের মধ্যে পঠনপাঠনের বিষয় ও সময়সূচির নির্ধারণের জন্যে প্রাথমিক কথোপকথন চলে (যেমন ‘প্রতি সোমবার ও বুধবার অঙ্ক ক্লাস হবে বিকেল পাঁচটা থেকে ছ’টা’, ইত্যাদি।) পুরো ব্যাপারটাই অনলাইন ঘটে। তার পর নির্ধারিত সময়ে ছাত্র-শিক্ষকের দেখা হয় একটি ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে, যে ক্লাসরুম আছে, আগেই বলেছি, ইন্টারনেটের মেঘের মধ্যে।
যেহেতু ‘ভার্চুয়াল’, সে কারণে এ রকম অসংখ্য ক্লাসরুম তৈরি হতে পারে, চাহিদা অনুযায়ী যে ক্লাসরুমে এক জন শিক্ষক ও এক জন ছাত্রও থাকতে পারে, আবার এক জন শিক্ষক এবং একাধিক ছাত্রও থাকতে পারে। এবং, সেই মুহূর্তে হয়তো সেই শিক্ষক লন্ডনে আর ছাত্র বহরমপুরে, শুধুমাত্র ইন্টারনেটের সংযোগ তাদের মধ্যে সংযুক্তি ঘটাতে পারছে। এই ইন্টারনেট-নির্ভর শিক্ষাপদ্ধতি আমাদের দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এক সার্বিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে।
অনলাইন টিউটরিং-এর সাহায্যে শহর-শহরতলি-গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাগত বিভাজন অনেকটা কমিয়ে শিক্ষার গুণগত মানের উন্নতি ঘটানো যে সম্ভব, তা প্রমাণ করে দেখিয়েছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এখন গ্রামেও ইন্টারনেট সংযোগ-ব্যবস্থা ক্রমশ ভাল হচ্ছে। তাই গ্রামের টিউশন-সেন্টারগুলি যদি ইন্টারনেট ব্যবহার করে শহরের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের এই শিক্ষণ-প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত করতে পারে, তা হলে শিক্ষার্থীর সার্বিক উন্নতি ঘটবে। এ ছাড়া, যেহেতু কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে পড়ানো হচ্ছে, তাই পাঠ্য বিষয়টি পড়ুয়াদের কাছে আরও সহজ এবং আকর্ষণীয় করে তুলতে শিক্ষকরা সহজেই ব্যবহার করতে পারবেন বিষয়-ভিত্তিক অডিয়ো এবং ভিডিয়ো, যা পড়ুয়াদের বিষয়টি ভাল ভাবে বুঝতে এবং মনে রাখতে সাহায্য করবে।
আমাদের দেশে অনেকগুলি প্রতিষ্ঠানই এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। দক্ষিণ ভারতের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গ্রামের স্কুলে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট বসিয়ে শহরের শিক্ষকদের সঙ্গে গ্রামের শিক্ষার্থীর সংযোগ স্থাপন করে শিক্ষাব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে। কলকাতা শহরের একটি সংস্থা কলকাতার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে একদিকে যেমন ব্যক্তিগত স্তরে অনলাইন টিউশন শুরু করেছে, অন্য দিকে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তৈরি করেছে ইন্টারনেট স্কুল। এখানে পড়ুয়ারা পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী শহরের অভিজ্ঞ শিক্ষকের কাছে শুধু যে অঙ্ক, বিজ্ঞান আর ইংরেজি শিখছে, তা নয়। তার সঙ্গে সঙ্গে গল্প-কবিতা-ছড়া-গান শোনা ও শেখার অভিনব সুযোগ ঘটছে তাদের।
বিদেশে ভার্চুয়াল বা অনলাইন স্কুল এখন এক স্বীকৃত বিকল্প শিক্ষাপদ্ধতি। অনেকে স্কুলে না গিয়েও এই পদ্ধতির সাহায্যে স্কুল-সার্টিফিকেট পেতে পারে। আমাদের দেশেও এই ভার্চুয়াল স্কুল একটা বিকল্প শিক্ষাপদ্ধতি হয়ে উঠতে পারে। এখানে মূল সমস্যা আপাতত একটাই— সুলভে হাইস্পিড-ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া। আশার কথা, সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে এই দ্রুতগতি ইন্টারনেট পরিষেবার প্রসার ঘটছে। এই পরিষেবার দাম এখন নিম্নবিত্ত মানুষের নাগালের বাইরে। কিন্তু আশা করা যায়, ভবিষ্যতে এই ইন্টারনেট পরিষেবা জল আর বিদ্যুতের মতোই সহজলভ্য এবং সুলভ হবে। তখনই এই শিক্ষা পদ্ধতি আরও বিস্তৃত এবং সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারবে।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, কলকাতায় শিক্ষক