Environment

দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সামনে ভয়াবহ সঙ্কট

১৯৭২ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ পাঁচ জুন দিনটিকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালনের ডাক দেয়। তা পালিতও হচ্ছে। কিন্তু পরিবেশ দূষণও চলছে। এ ভাবে আর কতদিন চলবে? পরিবেশ রক্ষার কাজে আর কবে সবাই মিলে উদ্যোগী হব? বিশ্ব পরিবেশ দিবসে লিখছেন দেবাশিস নাগপরিবেশের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মানুষ ও তাঁর চারপাশের গাছপালা, বায়ু, জল, মাটি—যা কিছুকে কেন্দ্র করে সে বেঁচে থাকে তা-ই তাঁর পরিবেশ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২০ ০১:৫২
Share:

ছবি সংগৃহীত।

নানা সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই আজ পালিত হবে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। নানা দিক থেকে বর্তমান বছরের পরিবেশ দিবস গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান বছরটিকে দুর্যোগে পূর্ণ বললেও কম বলা হয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং বিশ্বজুড়ে সেই অতিমারির প্রভাব, অন্য দিকে, আমপানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পঙ্গপালের হানা, নানা সমস্যায় জেরবার অর্থনীতি পর পর আঘাত এসেছে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, মানুষের নানা অনভিপ্রেত কাজকর্মের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য ক্রমশ নষ্ট হচ্ছে। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা তারই ফল। তবে এর মধ্যেও বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আগে কয়েকটি ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। গত কয়েক মাসে পৃথিবীর নানা প্রান্তে আংশিক বা পূর্ণাঙ্গ লকডাউনের কারণে পরিবেশ দূষণ কিছুটা হলেও কমেছে। দৃশ্যমানতা বাড়া, অনেক দিনের না দেখা পাখিদের ফিরে আসা, সমুদ্রের তীরে ডলফিন দেখা দেওয়ার মতো বেশ কয়েকটি ঘটনা আমরা দেখতে পেয়েছি। এ সব দেখে পরিবেশপ্রেমীরা বলছেন, প্রতি বছর তিন মাস অন্তর সাত দিন করে পুরোপুরি লকডাউন পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।

Advertisement

পরিবেশের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মানুষ ও তাঁর চারপাশের গাছপালা, বায়ু, জল, মাটি—যা কিছুকে কেন্দ্র করে সে বেঁচে থাকে তা-ই তাঁর পরিবেশ। প্রাচীন গ্রন্থগুলিতেও বলা হয়েছে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম— পঞ্চভূতের কথা। বলা হয়েছে, মানুষ-সহ যাবতীয় প্রাণ এই পঞ্চভূত থেকেই সৃষ্ট, পঞ্চভূত দ্বারাই গঠিত এবং এতেই লয়প্রাপ্ত হবে। এখানেই প্রাচীন দর্শনের সঙ্গে বর্তমান ভোগবাদী সভ্যতার পার্থক্য। প্রাচীন দর্শনে মানুষ প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন কোনও সত্তা নয়, বরং প্রকৃতির আর পাঁচটা জীবের মতোই সেও একটি জীব। অথচ অহংকারে বলীয়ান মানুষ নিজেকে প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন হিসেবেই দেখতে ভালবাসে। কিন্তু বিজ্ঞানও বলছে, প্রকৃতির বেশিরভাগ জীবের বেঁচে থাকে আদৌ মানুষের বেঁচে থাকার উপরে নির্ভরশীল ছিল না। বরং মানুষের অস্তিত্ব ছিল তাদের বেঁচে থাকার উপরে নির্ভরশীল। সেই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে বেঁচে থাকতে মানুষকে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে। এক দিন এই বেঁচে থাকার সংগ্রাম ভোগবাদী লালসা মেটানোর ইচ্ছায় পরিণিত হয়। যার নিট ফল, প্রকৃতির অন্য উপাদান অর্থাৎ পাখি, পশু ইত্যাদির বিপন্নতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষেরও বিপন্নতার সুর বাজতে শুরু করেছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রকৃতি থেকে ধারাবাহিক ভাবে বহু প্রজাতির পাখি ও পশু হারিয়ে যাচ্ছে। বউ কথা কও, ইস্টিকুটুম, নীলকণ্ঠের মতো পাখিদের আর সে ভাবে দেখা মেলে না। কমে গিয়েছে হাড়গিলে, শকুনেরাও। শহরাঞ্চলে এই দশকের গোড়ার দিকেও শোনা যেত চড়ুইদের কিচিরমিচির। সে আজও শোনা যায় না। ময়না, কাকাতুয়ার মতো পাখিরাও বিপন্ন। শুধু প্রাণী নয়, বিপন্ন হয়েছে উদ্ভিদেরাও। আজ আর সহজে ফলসা, আঁশফল, ডেলোর মতো ফলের গাছেদের দেখা মেলে না। এর জেরে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পাখিদের খাদ্য ব্যবস্থায়। আবার ঝোপজঙ্গলের অভাবে লোকালয়ে চলে আসছে গন্ধগোকুল, বাঘরোলের মতো প্রাণীরা। ইতিমধ্যে ভোঁদর-সহ নানা প্রাণী বিপন্নের তালিকাভুক্ত হয়েছে। বিপন্ন গাধার মতো প্রাণীরাও। গাধা শব্দটির সঙ্গে ছোটবেলা থেকে আমরা পরিচিত। কিন্তু সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, ভারতে গাধার সংখ্যা বেশ কম। হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার খালবিলের মৌরলা, পুঁটি, বেলের মতো মাছেরা। তাতে টান পড়তে শুরু করেছে দরিদ্র শ্রেণির মানুষের খাদ্যভাণ্ডারেও।

Advertisement

এই সঙ্কটে বিশেষ করে বলতে হয় জলদূষণের কথা। কারণ, গত কয়েক মাসে লকডাউন চলার কারণে প্রকৃতিতে দূষণের মাত্রা কমেছে। আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছি, দিঘা-সহ নানা সমুদ্র সৈকতে জলজ প্রাণীদের নিশ্চিন্তে বিচরণের কথা। অনেকে বলছেন, জলে দূষিত রাসায়নিক ও প্লাস্টিকজাত বর্জ্য পদার্থ কম থাকার কারণে দূষণ কমছে। কিন্তু তার পরেও জলদূষণ মিটছে না। বা তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার কোনও লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। পরিসংখ্যান বলছে, গঙ্গার দু’হাজারে কিলোমিটারেরও বেশি গতিপথের প্রায় এক পঞ্চমাংশ অর্থাৎ প্রায় চারশো কিলোমিটার জল প্রবল ভাবে দূষিত। প্রতি দিন সেই দূষিত জল ব্যবহার করেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। এর ফলে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। জলে কলকারখানা থেকে নির্গত রাসায়নিক ও ধাতুকণার হাত ধরে বাড়ছে অম্লত্বের পরিমাণ। অনেক সময়ে জলের দূষণে পরোক্ষ ভাবে ভূমিকা নিচ্ছে কৃষিকাজও। ভৌমজলের অপচয়, জলাশয় বুজিয়ে ফেলা সমস্যাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। ভৌমজলের অপচয়ের কারণে বাড়ছে জলে দ্রবীভূত ক্ষতিকারক রাসায়নিক যেমন, আর্সেনিকের মাত্রা। তারই সঙ্গে বাড়ছে নানা অসুখও।

অল্প কয়েক দিনের লকডাউন বায়ুদূষণে কিছুটা রাশ টানলেও সে অর্থে জলদূষণের উপরে কোনও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। দীর্ঘদিনের অপব্যবহারের ফলে প্রকৃতির জলচক্রের গোড়াতেই সমস্যা তৈরি হয়েছে। এক দিকে, ভূগর্ভস্থ জলস্তরের হ্রাস, অন্য দিকে সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা ও উষ্ণতাবৃদ্ধি বিপর্যয়ের সামনে নিয়ে আসছে গোটা জলচক্রকেই। তার প্রভাবে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটছে। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা ক্রমশ বাড়ছে। পরিবেশের অন্য সমস্যাগুলি মানুষের প্রাকৃতিক দূষণ কমানোর নানা প্রচেষ্টার মূলে আঘাত হানছে। আমপানের মতো বিপর্যয়ের জেরে এক দিকে, যেমন, পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা গাছপালাশূন্য হয়ে পড়েছে, তেমনই প্রাণ হারিয়েছে বহু পশুপাখিও। ফলে, প্রকৃতির চক্রগুলি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না গেলে সমস্যার কোনও স্থায়ী সমাধান হবে না।

প্রাচীনকালে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকে মানুষ অন্যতম কর্তব্য বলেই বিবেচনা করত। ফলে, আলাদা করে পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলনের দরকার হয়নি। পরে, প্রাকৃতিক পরিবর্তনের হার এত তীব্র হয়েছে যে, তাকে রক্ষা করার ডাক দিয়ে বারবার পথে নামতে হয়েছে মানুষকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলার পল্লিজীবন ও নগরজীবন— দুইয়ের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ পরিচয় থাকায় তাঁর নিজের মতো করে পরিবেশ রক্ষায় প্রয়াসী হয়েছিলেন। শিলাইদহ, শান্তিনিকেতন, সুরুল, কালীগ্রামের মতো নানা স্থানে প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে বিঘ্নিত না করে মানুষের উন্নতির চেষ্টা তাঁর ‘সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট’ বা স্থিতিশীল উন্নয়ন সংক্রান্ত চিন্তারই পরিচয়বাহী। তবে সে সময়ে বিষয়গুলি তত্ত্বাকারে গড়ে ওঠেনি। কিন্তু হলকর্ষণ, বৃক্ষরোপণ প্রভৃতি উৎসব চালু করার থেকে বোঝা যায় সমস্যার মূলে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছতে পেরেছিলেন।

পরিবেশকে কেন্দ্র করে আন্দোলন ও কর্মসূচি গ্রহণের সূত্রপাত মূলত বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। এই আন্দোলনের সূত্রপাতে রাচেল কার্সনের ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ গ্রন্থের ভূমিকা অপরিহার্য। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ পাঁচ জুন দিনটিকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালনের ডাক দেয়। তা পালিতও হচ্ছে। কিন্তু পরিবেশ দূষণও চলছে। এ ভাবে আর কতদিন চলবে? পরিবেশ রক্ষার কাজে আর কবে সবাই মিলে উদ্যোগী হব? সে প্রশ্ন করার সময় পেরিয়ে গিয়েছে। বর্তমানে নিজেদের প্রশ্ন করার দরকার, আদৌ কি এগোতে পারছি আমরা? পরিসংখ্যান কিন্তু বলছে, মানুষের সভ্যতা আরও ভয়াবহ সঙ্কটের সম্মুখীন হতে চলেছে।

লেখক ও গবেষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন