Refugee

শরণার্থী বিশ্ব

আজ যখন বিশ্ব শরণার্থী দিবস হিসাবে ২০ জুন দিনটি পালন হয়, কেউ ভাবতেই পারেন যে যিনিই এ কথা বলে থাকুন না কেন, তিনি সর্বজ্ঞ না হলেও অতীব দূরদর্শী। এই মুহূর্তে শরণার্থী বলতে কী মনে পড়ে?

শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০২৫ ০৫:৩৪
Share:

মিথ্যা, আরও বড় মিথ্যা এবং পরিসংখ্যান, দুনিয়ায় আছে কেবল এই তিন রকম বিষয়— এ কথা সত্যিই মার্ক টোয়েন বলেছিলেন না কি বেঞ্জামিন ডিজ়রায়েলি, না কি এঁরা কেউই নন, কেবল লোকশ্রুতি তাঁদের নামে প্রচলিত হয়ে গিয়েছে, বলা কঠিন। কিন্তু আজ যখন বিশ্ব শরণার্থী দিবস হিসাবে ২০ জুন দিনটি পালন হয়, কেউ ভাবতেই পারেন যে যিনিই এ কথা বলে থাকুন না কেন, তিনি সর্বজ্ঞ না হলেও অতীব দূরদর্শী। এই মুহূর্তে শরণার্থী বলতে কী মনে পড়ে? রাষ্ট্রপুঞ্জের তথ্য ও পরিসংখ্যানের বিস্তারিত হিসাবের মধ্যে যাওয়ার দরকার নেই। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধই এখনকার মানুষকে যথেষ্ট আতঙ্কিত করার মতো ছিল। তদুপরি গত পৌনে দুই বছর ধরে প্রত্যহ লাগাতার প্যালেস্টাইনে যা ঘটে চলেছে, এবং ইরান-ইজ়রায়েলের যুদ্ধে সম্প্রতি যা ঘটছে— তাতে আজ শরণার্থী কল্যাণ বা উদ্বাস্তুর অধিকার ইত্যাদি শব্দবন্ধ ব্যবহার করার নৈতিক অধিকারটিই এই পৃথিবী হারিয়েছে। বাস্তবিক, ২০২৫ সালটি এ দিক দিয়ে ঐতিহাসিক— অন্তত যত দিন পর্যন্ত আরও ভয়ঙ্করতর বাস্তব আজকের বাস্তবকে ছাপিয়ে যাচ্ছে না।

সাধারণত ভয়ঙ্কর শরণার্থী সমস্যার আলোচনাটি বাস্তুচ্যুতি, আশ্রয়হীনতা, অনাহার, অধিকারহীনতা, মানবিক সঙ্কটের দিক থেকেই করা দস্তুর। কিন্তু এই ঐতিহাসিক বছরটিতে উল্টো দিক থেকেও আলোচনা জরুরি। শেষ কবে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনায়করা প্রকাশ্য ভাবে আক্রান্ত অঞ্চলের মানুষের প্রতি এত নির্মম ভাষা প্রয়োগ করেছেন, এত নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন— বলা যায় না। ইজ়রায়েলের কথাই ধরা যেতে পারে। এই সেই দিন যখন তেল আভিভের সরকারি দায়িত্বপূর্ণ পদাধিকারী অনায়াসে বলতে পারেন, গাজ়া-র প্রতিটি শিশুই সম্ভাব্য সন্ত্রাসী তাই তাদের কারও বাঁচার অধিকার নেই, এবং তাঁর এই উক্তি বিশ্ব জুড়ে প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও তেমন প্রতিক্রিয়ার ঢেউ ওঠে না। কিংবা গাজ়া সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর জীবিতদের জীবনধারণের ন্যূনতম উপাদান সরবরাহ বন্ধ করা হয়, রাষ্ট্রপুঞ্জের ত্রাণ কমিটি কিংবা ইউএস-এড’এর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়, গ্রেটা থুনবার্গের মতো অনেকেই ত্রাণসাহায্য নিয়ে প্যালেস্টাইনে পৌঁছনোর চেষ্টা করলে তাঁদের আটক করা হয়। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে কয়েক বছর ধরে সমানে উদ্বাস্তু স্রোত ইউরোপের নানা দেশে ভিড় বাড়ালে তাঁদের উপর চলে বর্ণবৈষম্যবাদের আধুনিক পরীক্ষানিরীক্ষা। কিংবা ওয়াশিংটন ডিসি এবং তেল আভিভ থেকে একই সুরে ধ্বনিত হয় ইরানকে ঝাঁঝরা করে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা, কিন্তু ইউরোপ-এশিয়ার কোনও দেশই তাতে সজোর প্রতিবাদ জানানোর জোর দেখায় না। কিংবা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ধরে ধরে সমুদ্রে ছুড়ে দিতে পারে কোনও রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় পরিচিতিপত্র নেই বলে মানুষজনকে আক্ষরিক অর্থে ঠেলে সীমানার বাইরে বার করে দিতে পারে, অথচ পাশের দেশ সপাটে অস্বীকার করে তাঁদের গ্রহণ করতে। দেশে দেশে শাসকের নিষ্ঠুরতা ও নাগরিক সমাজের উদাসীনতা আজকের পৃথিবীতে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শরণার্থী কল্যাণের আলোচনাও তার নৈতিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক জোর হারিয়ে ফেলেছে। অচিন্তনীয় মানবিক দুর্দশার সমস্যা ঠান্ডা ঘরে বসে কত দূরই বা সমাধান করা যায়।

‘নিরাপদ’ দুনিয়া হয়তো এখনও ভাবতে পারছে না যে, নগর পুড়লে আগুন দেবালয় অবধিও এসে পৌঁছতে পারে। যে উদ্বাস্তুদের আজ অনেক দূরের মানুষ বলে মনে করে উদাসীন থাকা যাচ্ছে, তাঁদের অসহায়তা, যন্ত্রণা, ক্ষোভ, ক্রোধ অগ্নি সঞ্চার করতে পারে অন্যত্রও। ইউরোপে ইতিমধ্যেই সেই দাবানলের লক্ষণ। বিভিন্ন দেশে নাগরিক সমাজ ও উদ্বাস্তু জনসাধারণ যেন মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন আক্রমণ-প্রতিআক্রমণে। এই সময়ে উদ্বাস্তুরা যে সব দেশে আশ্রয়প্রার্থী, প্রতি ক্ষেত্রেই তাদের বিষয়টি আলাদা ভাবে বিবেচনা করতে হবে, সহানুভূতি সহকারে। কেবল ত্রাণ দিয়ে এই বিপুল আকারের সঙ্কট সামলানো অসম্ভব, বরং আইনি সহায়তা ও অর্থনৈতিক সহায়তার ব্যবস্থা জরুরি। অথচ ইউরোপ আমেরিকা এশিয়ায় যে ভাবে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির দ্রুত প্রসার হয়ে চলেছে তাতে এই সব কাজে রাষ্ট্রীয় মনোযোগ আশা করাই অবাস্তব। রাষ্ট্রপুঞ্জ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদাহরণ থেকে ক্রমশই বোঝা যাচ্ছে যে, সম্মিলিত ভাবে এই বিশ্বব্যাপী সমস্যার সমাধান প্রায় অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে যে সব রাষ্ট্রে দক্ষিণপন্থী কর্তৃত্ববাদ এখনও তত গভীরে প্রসারিত হতে পারেনি, তাদেরই এ বিষয়ে দায়িত্ব নিতে হবে। মানব-ইতিহাস একটি সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। শরণার্থী সঙ্কটের সুরাহা ছাড়া তার অগ্র/সম্মুখ-গতি অসম্ভব।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন