—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
কিছু দিন আগে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার ভারতীয় টাকার রেটিং কমায়। তার পিছনে একটা বড় কারণ ছিল, ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক কৃত্রিম ভাবে টাকার দাম ধরে রাখার চেষ্টা করে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ভান্ডারে থাকা ডলার বিক্রি করে বাজারে টাকার অনুপাতে ডলারের জোগান বাড়ানো হয়, তার ফলে টাকার সাপেক্ষে ডলারের দাম কমে। অর্থ ভান্ডারের এই অভিযোগের যাথার্থ্য প্রমাণ করল রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের বুলেটিন। জানা গেল, সেপ্টেম্বরের শেষে ডলারের দাম প্রায় ৮৯ টাকায় পৌঁছে যাওয়ায় ব্যাঙ্ক বিপুল অঙ্কের ডলার বিক্রি করেছিল, যার ফলে টাকার দাম এক শতাংশের কাছাকাছি বাড়ে। কিন্তু, টাকার পতন পাকাপাকি ভাবে রোধ করা যায়নি। ডিসেম্বরে যখন ডলারের দাম সর্বকালীন রেকর্ড গড়ে ৯১ টাকায় পৌঁছল, তখনও রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক বিক্রি করল বিপুল পরিমাণ ডলার। তাতে টাকার দাম আবারও এক শতাংশের কাছাকাছি কমল। এ মাসের গোড়ায় ব্যাঙ্কের কর্তা সঞ্জয় মলহোত্র বলেছিলেন, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক টাকার দাম নির্ধারণে বাজার প্রক্রিয়ার উপরে ভরসা রাখে— শুধুমাত্র যখন দামে কোনও অস্বাভাবিক ওঠা-পড়া হয়, তখনই ব্যাঙ্ক তাতে হস্তক্ষেপ করে। ‘অস্বাভাবিক’ কথাটির তো কোনও সংজ্ঞা হয় না। ফলে, সাম্প্রতিক অতীতে যে ভাবে টাকার দামের পতন রোধ করার চেষ্টা হয়েছে, সে সব ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ‘অস্বাভাবিক’ ছিল কি না, তা বোঝার কোনও উপায় নেই। তবে এ কথা স্পষ্ট যে, ডলার বেচে টাকার দামের পতন রোধ করার পদ্ধতিটি পাকাপোক্ত সমাধান নয়। ফলে, অবস্থা কতখানি ‘অস্বাভাবিক’ হলে তবে ডলার বেচে টাকার দামকে স্থিতিশীল করা বিধেয়, সে বিষয়ে স্পষ্ট নীতি প্রয়োজন।
কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করতে পারেন যে, ব্যাঙ্কের ডলার বেচার সিদ্ধান্তটির পিছনে রাজনৈতিক প্রভাব আছে। টাকার দামের বেলাগাম পতন কেন্দ্রীয় সরকারের উপরে— বিশেষত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপরে— যথেষ্ট রাজনৈতিক চাপ তৈরি করেছে। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন মোদী টাকার দামের পতন বিষয়ে যে কথাগুলি বলেছিলেন, এখন তাঁর বিরুদ্ধেই সে কথা ফিরে আসছে। এই অবস্থায় ব্যাঙ্কের উপরে চাপ তৈরি করে তাদের ডলার বিক্রির সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা হচ্ছে, কেউ এমন আশঙ্কা প্রকাশ করলে তা উড়িয়ে দেওয়া মুশকিল। গত এক দশকাধিক সময়কালে ভারতে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলির উপরে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এমনই তীব্র হয়েছে যে, কোনও প্রতিষ্ঠানেরই আর মেরুদণ্ড অবশিষ্ট আছে বলে আশা করতে ভরসা হয় না। ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কও যদি রাজনৈতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়, তবে তা শুধু দুর্ভাগ্যজনক হবে না, আক্ষরিক অর্থে ভয়াবহ হবে। মুদ্রা নীতি নির্ধারণে ব্যাঙ্কের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা খর্ব হলে তা ভারতীয় অর্থব্যবস্থাকে গভীর বিপদে ফেলবে।
টাকার বিনিময় মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাজার প্রক্রিয়ার উপরে ভরসা রাখাই শ্রেয়। বিশেষত এই মুহূর্তে, যখন ভারতে অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির হার তলানিতে। ফলে, টাকার দাম কমায় আমদানি মহার্ঘতর হলেও তজ্জনিত মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়ার সাধ্য এই মুহূর্তে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার রয়েছে। অন্য দিকে, বিশেষত আমেরিকার শুল্কযুদ্ধের ফলে ভারতীয় রফতানি এ বছর খানিক বিপাকে পড়েছে। শুধু আমেরিকাই নয়, চিন ব্যতীত ভারতের প্রতিটি বৃহৎ বাণিজ্যসঙ্গী দেশে ভারতের রফতানির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে টাকার দাম যদি বাজারের নিয়ম মেনে হ্রাস পায়, তা হলে ভারতীয় রফতানিকারকদের সুবিধা। বিশেষত, আমেরিকার যথেচ্ছ বাণিজ্য নীতির মুখাপেক্ষী হয়ে না থাকতে চাইলে ভারতকে এই মুহূর্তে নতুন ও নির্ভরযোগ্য বাণিজ্যসঙ্গী এবং জোটের সন্ধান করে চলতে হবে। সে ক্ষেত্রে টাকার বিনিময় মূল্য কম থাকার সুবিধা রয়েছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যদি ভারতের মুদ্রা নীতিকে প্রভাবিত করতে থাকে, তবে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হবে।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে