Bengali

মুষলপর্ব

হালের বাঙালি বেহাল। তাদের মুখের বাংলা দিশাহারা, কেন্দ্রহীন। যে যা পারছেন বলছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিশিষ্ট পদাধিকারীর কোনও পার্থক্য নেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৪৫
Share:

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন আমাদের সকলের জীবনেই ‘পূর্বমেঘ’ যেমন থাকে, তেমন ‘উত্তরমেঘ’ও থাকা চাই। এই দুয়ের সামঞ্জস্যেই মানবজীবন স্থিতি পায়। কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যে ‘পূর্বমেঘ’ বিচিত্র দৃশ্যের সমাহারে পরিপূর্ণ, আর ‘উত্তরমেঘ’ যক্ষের প্রিয়ার কথায় একমুখী। পূর্বমেঘে বহু, উত্তরমেঘে এক। পূর্বমেঘ চপল, উত্তরমেঘ সুগম্ভীর। কেবল বৈচিত্রের বিস্তার থাকলেই চলবে না, একক কেন্দ্রও থাকা চাই। কেবল চপলতা থাকলেই চলবে না, চিন্তাশীল গাম্ভীর্যও অত্যাবশ্যক। না হলে জীবন-জগৎ ছন্নছাড়া হয়ে যায়। লঘু-গুরুতেই পথ চলা। এ কথা কেবল জীবনের প্রেম-বিরহের ক্ষেত্রেই সত্য নয়, কোনও ভাষাগোষ্ঠীর সংস্কৃতি সম্বন্ধেও সত্য। তবে দুঃখের কথা, এই হুজুগে বাঙালি বৈচিত্রের লোভে কেন্দ্রের দৃঢ়তাকে হারিয়ে ফেলে। তার মুখের ভাষা, লেখার ভাষা হুজুগের ফেরে এখন পাক খায়। সেই ঘূর্ণিপাকে বিপর্যয়— বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি শ্রীহীন কাকতাড়ুয়া। সে কাকতাড়ুয়ার শরীরে নানা রঙের নানা উপাদান, অথচ দেখলে কেমন ভয় করে, ভরসা হয় না। ঝড় উঠলে তার পা মাটিতে থাকবে না, কেন্দ্রহীন বলেই মিলিয়ে যায়। মহাত্মা গান্ধী ঘরের সব জানলা-দরজা খুলে রেখেও পা মাটিতে শক্ত করে রাখতে বলেছিলেন। বাঙালি তার পায়ের ভূমি হারিয়েছে।

Advertisement

অথচ, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে তো দৃঢ়তার অভাব ছিল না। সেই দৃঢ়তা বহুমানুষের বহুসাধনার ফল। প্রাগাধুনিক পর্বে বঙ্গভাষার বৈষ্ণব-শাস্ত্রধারা অনুসরণ করলে দেখা যায় সেখানে চৈতন্যচরিতামৃত-র মতো গ্রন্থ রচিত হয়েছে। সে-গ্রন্থের ভিত্তি সংস্কৃত ভাষার শাস্ত্রীয় প্রজ্ঞা, সে গ্রন্থের প্রকাশ-বিন্যাসে বাঙালির স্বভাবসিদ্ধ ভক্তি আকুলতা। উনিশ শতকেও বাঙালি চিন্তকেরা বঙ্গভাষা-সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ও ঐতিহ্যের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করতে পেরেছিলেন। বাঙালি যেমন সংস্কৃত থেকে গ্রহণ করেছে, আরবি-ফারসি-ইংরেজি থেকে নিয়েছে, তেমনই অন্যান্য উপাদানও ফেলে দেয়নি। রামমোহন রায়ের রচনা তার প্রমাণ। রামমোহনের পথ ধরেই পরবর্তী বাঙালি চিন্তকদের যাত্রা। সংস্কৃতজ্ঞ বিদ্যাসাগর তাঁর সংস্কৃত-ব্যাকরণ রচনার ক্ষেত্রে যে আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন, তাই বাংলা-ভাষায় ও বাঙালি-জীবনে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। বিদ্যাসাগর তাঁর সংস্কৃত ব্যাকরণ বইটিতে সংস্কৃত ব্যাকরণের জটিলতাকে সহজগম্য ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন, তাতে ভাষার ধ্রুপদী ঘরানা রক্ষা পেয়েছিল, আবার বাংলা ভাষার ক্ষেত্রটিও স্বীকৃতি লাভ করল। বিদ্যাসাগর চাইতেন সংস্কৃত কলেজের পড়ুয়ারা বাংলা ভাষা ভাল করে শিখুক, চর্চা করুক। পড়ুয়াদের ইংরেজি শিক্ষার উপরেও তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সে সময় বলা হত বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত ব্যাকরণ রেলগাড়ি। বাঙালি পড়ুয়াদের দ্রুত ঈপ্সিত লক্ষ্যে উপস্থিত করে সে বই। রবীন্দ্রনাথের ভাষাচিন্তা অনুসরণ করলে দেখা যাবে তিনিও সংস্কৃত-ইংরেজি-বাংলা তিনটি ভাষা শেখানোর পক্ষপাতী। পড়ুয়াদের এই তিনটি ভাষা শেখানোর জন্য তিনি সহজ পাঠ্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। অর্থাৎ বাঙালি তার নিজত্ব, বৈচিত্র ও দার্ঢ্য বজায় রাখুক, এই ছিল চিন্তকদের বাসনা।

হালের বাঙালি বেহাল। তাদের মুখের বাংলা দিশাহারা, কেন্দ্রহীন। যে যা পারছেন বলছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিশিষ্ট পদাধিকারীর কোনও পার্থক্য নেই, সকলেই সমান দায়িত্বজ্ঞানশূন্য। মুখে যা আসছে তাই যে বলা যায় না, যে মশকরা করতে ইচ্ছে করছে সেই মশকরার স্রোতে যে গা ভাসানো যায় না, এ সত্য থেকে বাঙালি বিচ্যুত। মহাভারতে যাদব-যুবারা তাদের ধ্রুপদী বোধ হারিয়েছিল। স্থিতধী ঋষির সঙ্গে অহেতুক রসিকতা করেছিল। সেই রসিকতা থেকেই প্রাণঘাতী আত্মধ্বংসী মুষলপর্বের সূত্রপাত। রসিকতা করতে গিয়ে শেষে একে অপরকে অস্ত্রাঘাতে শেষ করে দিল। বাঙালি যদি এই বোধহীন যা ইচ্ছে তাই ভাষায় সকল বিষয়ে রসিকতা করতে শুরু করে, তা হলে তাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠবে। সেই ধ্বংসের ইঙ্গিত সর্বত্র। ভাষা সংস্কৃতি সবই ব্যক্তি ও সমূহের চরিত্রের বাহ্যিক প্রকাশ। ব্যক্তি বাঙালি ও গোষ্ঠী বাঙালির চরিত্রে এখন প্রয়োজন কেন্দ্র ও পরিধির সংযোগ। পরিধিতে নানাত্বকে গ্রহণ করতে হবে। ভাষা সংস্কৃতিকে সচল হতে হবে। বিশ্বায়নের সুযোগে সর্বত্রচারী হতে হবে। তবে এই উত্তরমেঘের যাত্রায় পূর্বমেঘকে ভুলে গেলে চলবে না। বাঙালি দার্ঢ্য ভাষা-সংস্কৃতির বাঁধন— তা বহুসাধনার ফল ও ফসল। তা স্মরণ করতে হয়, নিজের ভাষা সংস্কৃতিকে সজীব রেখেও তা ধারণ করতে হয়।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন