Syndicate

খাজনা আদায়

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই হল শাসনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে অগ্রাহ্য করা। ব্যাধিটি বাম জমানার, তার প্রকোপ এখনও অব্যাহত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০২২ ০৫:০৬
Share:

প্রতীকী ছবি।

এক সময় সিপিএমের লোকাল কমিটির নির্দেশ ছাড়া গাছের পাতাটিও নড়ত না। শাশুড়ি-পুত্রবধূর বিবাদেরও মীমাংসা হত লোকাল কমিটির সালিশিসভায়। আজ সেই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটও নেই, সেই লোকাল কমিটিও নেই। তবে, বেড়াল উধাও হলেও হাসিটি থেকে গিয়েছে। অভিযোগ, সিপিএমের পতাকাটি প্রবলতর শক্তিতে তুলে নিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় নেতারা। প্রায় প্রতি দিনের সংবাদপত্রেই এই অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ মেলে। যেমন, সম্প্রতি অভিযোগ উঠল যে, ডানকুনি পুরসভার এক পুরপ্রতিনিধি জমিসংক্রান্ত বিবাদকে কেন্দ্র করে এক বৃদ্ধকে সপরিবার খুন করার হুমকি দিলেন। স্বীকার করতেই হবে যে, আজকের পশ্চিমবঙ্গেও এ-হেন হুমকি ব্যতিক্রমীই। কিন্তু, অরাজনৈতিক পরিসরের প্রতিটি ঘটনায় নাক গলানোর অভ্যাসটি একেবারে নিয়ম। সিন্ডিকেটের কথা বহু-আলোচিত। কারখানা বা বড় আবাসন প্রকল্পে তো বটেই, অভিযোগ যে, কেউ বাড়িতে রান্নাঘরটুকু সারাই করতে চাইলেও সিন্ডিকেটের হাত থেকে নিস্তার নেই। কিন্তু, তার বাইরেও সর্বত্রই রাজনৈতিক ক্ষমতাবানদের উপস্থিতি অমোঘ। বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে বিবাদ থেকে পাড়াতুতো প্রেম, ডাক্তার-রোগীপক্ষের অশান্তি থেকে অটোর লাইন, বন্যাত্রাণ বণ্টন থেকে স্কুলের পরীক্ষার অনলাইন-অফলাইন তরজা— শাসক দলের স্থানীয় নেতার উপস্থিতিহীন বিবাদের পরিসর পশ্চিমবঙ্গে পাওয়া শুধু দুষ্করই নয়, অসম্ভব।

Advertisement

এই সর্বব্যাপী রাজনৈতিক উপস্থিতির একটি বড় কারণ যে অর্থনৈতিক, সে কথা অনস্বীকার্য। দুর্জনে বলে যে, এই রাজ্যে এখন কর্মসংস্থানের বৃহত্তম ক্ষেত্রটি হল শাসক দল। কিন্তু, অরাজনৈতিক সামাজিক ক্ষেত্রের যত বিবাদে শাসক দলের মেজো-সেজো নেতারা প্রত্যহ নাক গলান, তার সবই সমান অর্থকরী, অথবা আদৌ অর্থকরী, তেমন দাবি করা মুশকিল। যেমন, পেশেন্ট পার্টির সঙ্গে চিকিৎসকের বিবাদে প্রত্যক্ষ আর্থিক লাভের সম্ভাবনা খুব বেশি নয়। অথবা, শাশুড়ি-পুত্রবধূর বিবাদ মিটিয়ে কাঞ্চনমূল্যে দক্ষিণা বুঝে নেওয়া কঠিন। এই হস্তক্ষেপের মূল কারণ আসলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। প্রমাণ করা যে, থানা থেকে আদালত, কিছুরই প্রয়োজন অথবা গুরুত্ব নেই— যে কোনও বিবাদে তদন্তকারী, মধ্যস্থতাকারী এবং বিচারকের ভূমিকায় আসলে রয়েছেন স্থানীয় নেতা। অবিকল সিপিএমের মডেল, সন্দেহ নেই— সেই আমলে ছিল সবার উপরে পার্টি সত্য, এখন সম্ভবত সেই স্থানটি গোষ্ঠী বা উপগোষ্ঠী অধিকার করেছে। কিন্তু, মূল কথাটি অপরিবর্তিত থেকে গিয়েছে— শাসনের যে প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় রূপ, তাকে গ্রাহ্য করার প্রয়োজন নেই, কারণ সব ক্ষমতাই রাজনীতির কুক্ষিগত। বাম আমলের সঙ্গে ফারাক হল, তখন এই রাজনৈতিক ক্ষমতার একটি কেন্দ্রীভূত রূপ ছিল, এখন গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠীসঙ্কুল রাজ্যে কোথাওই কোনও সরলরেখা টানা মুশকিল। কিন্তু, অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায় যাকে ‘রেন্ট সিকিং’ বলা হয়, এই রাজনৈতিক আধিপত্য দিয়ে সেই খাজনা আদায়ের প্রথাটি যথা পূর্বং বলবৎ।

সংবাদে প্রকাশ যে, ডানকুনির পুরপ্রতিনিধিকে দলের নেতৃত্ব খানিক তিরস্কার করেছেন। তাতে পরিস্থিতি পাল্টাবে, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ, রোগটির শিকড় স্থানীয় স্তরে নয়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই হল শাসনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে অগ্রাহ্য করা। ব্যাধিটি বাম জমানার, তার প্রকোপ এখনও অব্যাহত। রাজনৈতিক নেতারা যে রাষ্ট্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠানের প্রতিস্পর্ধী বা বিকল্প নন, সংজ্ঞাগত ভাবেই তাঁরা যে সাংবিধানিক শাসনের ধারকমাত্র, এই কথাটি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি মনে রাখার চেষ্টাই করেনি। স্থানীয় নেতারা দেখে শিখেছেন। ফলে, যত ক্ষণ না শীর্ষ স্তর প্রশাসনকে মেনে চলার দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে, তত ক্ষণ অবধি প্রতীকী তিরস্কারের গুরুত্ব কণামাত্র নয়।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন