Tiger Census

কাগুজে বাঘ

প্রাণের আদিলগ্ন থেকেই বন্য প্রকৃতির সঙ্গে বনবাসী মানুষের একটি অলিখিত চুক্তি রয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলি পুনর্নবীকরণ না করলে বাঘ, সিংহ, চিতা বা লেপার্ড— কোনও শ্বাপদের সঙ্গেই কোথাও মানব সহাবস্থান সম্ভব নয়।

শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:৩০
Share:

ষষ্ঠ জাতীয় বাঘশুমারি শুরু করার নির্দেশিকা জারি হয়েছে, ফলাফল ঘোষণা হবে ২০২৬ সালে। এ নিয়ে দেশের বন দফতরের প্রচারের আড়ম্বর লক্ষণীয়। রাজ্যে রাজ্যে বাঘের সঙ্গে গণনা হবে সহশিকারিদের— লেপার্ড, হায়েনা, শিয়াল, কুমিরেরও। যাচাই করা হবে খাদ্যশৃঙ্খলের সুস্বাস্থ্য। ফলে, হরিণ, বুনো মোষ, বাঁদর ইত্যাদিরও পরিসংখ্যান নেওয়ার কথা। সব মিলিয়ে ভারতের বাঘশুমারি বিশ্বের বৃহত্তম বন্যপ্রাণ সমীক্ষা বলে দাবি করা হয়। গত বাঘশুমারির পর কর্তারা সগৌরবে জানিয়েছিলেন যে, দেশে বাঘ বেড়েছে যথেষ্ট। বাঘের সংখ্যা ৩১৬৭ থেকে ৩৯২৫-এর মধ্যে। তাঁরা এও দেখিয়েছিলেন যে, বিশ্বের মোট বাঘের ৭০ শতাংশের বেশি ভারতেই। তখনই আর একটি তথ্যে উৎসবের সুর কেটেছিল। এত বাঘের থাকার মতো জঙ্গল কিন্তু দেশে নেই। এই পরিস্থিতিতে বাঘ বাড়লে বন দফতরের কাজও কঠিনতর হয়।

জানা গিয়েছে, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত দশ মাসেই দেশে অন্তত ১২৫টি বাঘ মারা গিয়েছে। গত শুমারি থেকে হিসাব ধরলে সংখ্যাটি ন্যূনতম ৫৫৫। গত শুমারিতে যে রাজ্যে সবচেয়ে বেশি বাঘ বৃদ্ধির খবর পাওয়া গিয়েছিল, সর্বাধিক বাঘমৃত্যুও ঘটছে সেই মধ্যপ্রদেশেই। পঞ্চম শুমারির অঙ্কমতো রাজ্যটিতে বাঘেদের প্রায় অর্ধেকের অবস্থান ছিল সংরক্ষিত এলাকার বাইরে। আর, শুমারির ফলাফলে বাঘের সংখ্যা সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্নের সীমা হিসাবে দর্শানোতেই স্পষ্ট হচ্ছে, শুমারি প্রক্রিয়া বৈজ্ঞানিক হলেও নির্ভুল নয়। অতিরিক্ত গুনতির সম্ভাবনা যথেষ্ট। প্রকৃতপক্ষে, প্রোজেক্ট টাইগারের আপাত-সাফল্যের আলোয় ঢাকা বহু প্রশ্ন, অভিযোগ, নড়বড়ে পরিকাঠামো, সচেতন কর্মীর অভাব। ফলাফল: জঙ্গলজীবীদের রোষ, বাঘ-মানুষ সংঘাত, জঙ্গল সঙ্কোচন, বাঘ করিডরে খনি ইত্যাদি নানা প্রকল্পের অনুমোদন, একের পর এক পশুরোগের খবর এবং চোরাশিকার বন্ধ করতে ব্যর্থতা। শুধু বাঘ বাড়ছে বলেই নয়, এই সব জটিলতার সম্মিলিত প্রভাবও বাঘেদের জীবনহানির কারণ হচ্ছে। বাঘসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাঘের জঙ্গলও বাড়ানো হচ্ছে— এই আশ্বাসও কি গ্রহণযোগ্য? সংরক্ষিত বাঘবন হওয়ার যোগ্যতা হিসাবে পরিবেশের বদলে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক তাঁবেদারিকে। এই বছরই সিংহ গণনায় পশুরাজের সংখ্যার ঊর্ধ্বগতি নিয়ে যে উচ্ছ্বাস দেখা গেল, তাতেও ধন্দ। গির-এও বাসস্থানের সঙ্কটে সিংহেরা সংরক্ষিত এলাকার বাইরে, অভূতপূর্ব ভাবে তৈরি হচ্ছে মানব-পশু সংঘাত। একটি জায়গায় আবদ্ধ এই সিংহগুলি একটি কঠিন রোগের প্রকোপে পড়লেই নির্মূল হয়ে যাওয়ার তীব্র আশঙ্কা।

প্রাণীগুলির প্রজননের হার ভাল হওয়ার কারণে বাঘসংখ্যা বাড়ানো সহজ। কিন্তু, সেই সংখ্যাকে তো টিকিয়েও রাখতে হবে। সংরক্ষণের সেটিই তো মূল উদ্দেশ্য। বাঘ বা অন্য শ্বাপদের নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করতে জঙ্গলের ধারণক্ষমতাটিকে স্পষ্ট নিরীক্ষার আওতায় রাখা জরুরি। কিন্তু তার জন্য বনের মানুষদের বঞ্চিত করলে কখনওই চলবে না। প্রাণের আদিলগ্ন থেকেই বন্য প্রকৃতির সঙ্গে বনবাসী মানুষের একটি অলিখিত চুক্তি রয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলি পুনর্নবীকরণ না করলে বাঘ, সিংহ, চিতা বা লেপার্ড— কোনও শ্বাপদের সঙ্গেই কোথাও মানব সহাবস্থান সম্ভব নয়। সংখ্যাতত্ত্বের বাগাড়ম্বর নয়, সংরক্ষণের সারসত্য এটিই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন