Coal Mine

মৃত্যুফাঁদ

প্রতি বারই খনি দুর্ঘটনায় মৃত্যু এবং দেহ উদ্ধারের ঘটনার পরে কিছু শোরগোল হয়, তাহাতে অবৈধ কয়লাচক্রের উৎপাদন ও বিপণন ক্ষণমাত্র থমকায় না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৪:৪৩
Share:

এই বৎসর প্রজাতন্ত্র দিবসে দুর্গাপুরের ফরিদপুর-লাউদোহা ব্লকে খোলামুখ কয়লাখনিতে কয়লা আহরণ করিতে গিয়া একই পরিবারের চার শ্রমিকের মৃত্যু হইল। চার দিন পরে ঝাড়খণ্ডের নিরশার খোলামুখ কয়লাখনিতে পাথরের চাঁই চাপা পড়িয়া প্রাণ হারাইলেন পাঁচ জন। ঝাড়খণ্ডে ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠিত হইয়াছে। ফল বাহির হইলে কিছু সুপারিশ মিলিবে, কিন্তু সুরক্ষা মিলিবে কি? বাস্তব ইহাই যে বিহার, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, তেলঙ্গানা, মেঘালয়ের খনিগুলিতে প্রতি দিন কয়েক লক্ষ শ্রমিক জীবন বাজি রাখিয়া কয়লা তুলিতে নামেন। তাঁহাদের একটি অংশ আইন-বিধির বৃত্তের বাহিরে— হয় অবৈধ খনিতে কয়লা কাটিতে যান, অথবা বৈধ খনি হইতে কয়লা চুরি করেন। ইহারা অধিকাংশ স্থানীয় মানুষ, চাষের জমি ক্রমশ খনি হইয়া যাওয়ায় অপরাপর জীবিকা হারাইয়াছেন। অবৈধ কয়লা বা অনাহারে মৃত্যু, এই উভয়সঙ্কটে তাঁহারা বাঁচিতেছেন, এবং ভাগ্য মন্দ হইলে কয়লা, পাথর, মাটি চাপা পড়িয়া প্রাণ হারাইছেন। বৈধ খনিতে কাজে নামিয়া বৈধ শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনাও কম ঘটে নাই। প্রতি বার অনুসন্ধান হইয়াছে, এবং নির্দিষ্ট সুরক্ষাবিধি না থাকিবার, অথবা না মানিবার ঘটনা সম্মুখে আসিয়াছে।

Advertisement

শ্রমিকের প্রাণের ঝুঁকির নিরিখে ভারতের খনিগুলি সর্বাধিক ঝুঁকিসম্পন্ন খনির অন্যতম, ২০১৭ সালে প্রতি ছয় দিনে এক জন শ্রমিক প্রাণ হারাইয়াছিলেন। সংসদে পেশ করা তথ্য অনুসারে, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ভারতের কয়লাখনিতে ২১০ জন শ্রমিক প্রাণ হারাইয়াছেন, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে চুরাশি জনের মৃত্যু হইয়াছে। কত খনির গভীর তলদেশে কত দেহ চাপা পড়িয়া আছে, কে তাহার হিসাব করিবে? কোনও বৎসরই এই মৃত্যু মিছিলে ছেদ পড়ে নাই, এই বৎসর শুরু না হইতেই এই মর্মান্তিক গণনা শুরু হইয়া গেল। খনি অঞ্চলগুলির সঙ্গে যাঁহাদের কিছুমাত্র পরিচয় রহিয়াছে, তাঁহারাই জানেন যে আইনের শাসন সেই সকল অঞ্চলে একটি ধারণামাত্র। এক দিকে চরম দারিদ্র, বিকল্প জীবিকার অভাব, চটজলদি রোজগারের প্রলোভন, অপর দিকে এক ভয় ও হিংসার বাতাবরণে বসবাস, এই সকল অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের নিকট দৈনন্দিন মৃত্যু-মোকাবিলাকেই ‘স্বাভাবিক’ করিয়া তুলিয়াছে। বৈধ খনিও বিপন্মুক্ত নহে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার খনিগুলিতেও ঠিকাদার নিয়োগ বাড়িতেছে। প্রশিক্ষণহীন পরিযায়ী শ্রমিকদের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে কাজ করিতে বাধ্য করে ঠিকাদার, এই অভিযোগ বার বার উঠিয়াছে। ভারতের খনিগুলিতে সর্বস্তরের কর্মীর যথাযথ সুরক্ষা প্রশিক্ষণের আর্জি জানাইয়াছিল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। ২০১৪ সালের সেই সুপারিশ কতটুকু সম্মান পাইয়াছে, এই বৎসরের নয়টি মৃত্যু তাহা দেখাইল।

প্রতি বারই খনি দুর্ঘটনায় মৃত্যু এবং দেহ উদ্ধারের ঘটনার পরে কিছু শোরগোল হয়, তাহাতে অবৈধ কয়লাচক্রের উৎপাদন ও বিপণন ক্ষণমাত্র থমকায় না। এই বৃহৎ ব্যবস্থার এক দিকে বেপরোয়া শ্রমিক, অপর দিকে বিবেকহীন খরিদ্দার। পথপার্শ্বের ধাবা হইতে স্পঞ্জ আয়রন কারখানা, সকল ব্যবসাকে এই অবৈধ ব্যবস্থা জ্বালানি জুগাইয়া যায়। এই বিপুল অপরাধাশ্রিত ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করিবার জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং প্রশাসনিক দৃঢ়তা প্রয়োজন, তাহার খোঁজ আজও মেলে নাই।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন